এমন অবাক করার মতোই তথ্য ও সমীকরণ মিলেছে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে।
ফায়ারে যেমন তৃণমূলের কোনো মতামত নেওয়া হয় না, বা কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় না, আবার হায়ার করার ক্ষেত্রেও তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয় না।
রংপুর জাতীয় পার্টির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বছরের পর বছর পার্টির জন্য জীবন বাজি রেখে খেটেছে একজন। আর ভোটের আগে নেতা হায়ার করে এনে মনোনয়ন দেওয়ায় দুর্গেই আজ নিভুপ্রদীপ জাপা।
ওই নেতা বলেন, রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে নব্বইয়ে এরশাদ জেলে গেলে পার্টির হাল ধরেন পরিবহন ব্যবসায়ী গফুর সরকার। তিনি দলকে সংগঠিত করেন। নিজের জমি-জমা বিক্রি করে দলের পেছনে ব্যয় করেন। ১৯৯১ এর নির্বাচনে জেল থেকে বিজয়ী হন এরশাদ। উপ-নির্বাচনে গফুর সরকারকে মনোনয়ন না দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় নেতা শাহ মোয়াজ্জেমকে।
একইভাবে ৯৬ সালেও সরাসরি নির্বাচনে বিজয়ী হন এরশাদ। উপ-নির্বাচনে আগে দলে ভেড়ানো হয় বিএনপি নেতা নূর মোহাম্মদ মন্ডলকে। ত্যাগী নেতা গফুর সরকারকে মনোনয়ন না দিয়ে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী করা হয় নূর মোহাম্মদ মন্ডলকে। এতে দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। দলে নতুন ধারা তৈরি হয় নূর মোহাম্মদকে ঘিরে।
এরপর কয়েক দফায় নূর মোহাম্মদ প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে জাপা। জাপার মনোনয়ন না পেয়ে সদলবলে আবার বিএনপিতে ফিরে যান নূর মোহাম্মদ। আসার সময় একা এলেও এবার কিন্তু জাতীয় পার্টির অনেক নেতাকে নিয়ে চলে যান তৈরি হয় নেতৃত্বের শূন্যতা। যা এখনও কুরে কুরে খাচ্ছে পীরগঞ্জ জাপাকে।
খোদ রংপুর-৩ সদর আসনও একইভাবে দূষিত করা হয়। এরশাদ মুক্তির আন্দোলনে নিজের জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করে সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা বাটুল। আর পুরস্কৃত করা হয় ভাড়াটিয়া নেতা সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে। যথারীতি তিনিও দুর্দিনে লাঙলের মুঠো ফেলে দিয়ে নৌকায় গিয়ে ওঠেন। আর জাপাকে ভরাডুবি করে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন।
একইভাবে রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনেও জাপাকে পঙ্গু করা হয় নেতা হায়ারের মাধ্যমে। এই আসনে ২০০১ সালের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী করা হয় সোলায়মান আলম ফকিরকে। যথারীতি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএন আশিকুর রহমানকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সোলায়মান ফকিরকে বাদ দিয়ে হায়ার করে আনা হয় শিল্পপতি জাহাঙ্গীর আলমকে। এতে পার্টির মধ্যে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়ে। যথারীতি আওয়ামী লীগ প্রার্থী আশিকুর রহমানের কাছে ভরাডুবি হয় লাঙলের। এরপর থেকে হাতছাড়া রংপুরের এ আসনটি।
এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে প্রার্থী হায়ার করায় দলের ভরাডুবির। কিন্তু তারপরও কি কমেছে এই প্রবণতা। না সম্প্রতি খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এভাবে হঠাৎ করে বিএনপি থেকে মুশফিকুর রহমানকে হায়ার করা হয় তৃণমূলের অগোচরে। যোগদান সভায় তাকে খুলনার মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে খুলনায় গণপদত্যাগের ঘটনা ঘটে। তারপরও কেন্দ্র তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। তৃণমূলের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাকেই মেয়র প্রার্থী করা হয়, ফলাফল খুলনা সিটি করপোরেশনে জামানত খুইয়ে ইমেজ সংকটে পড়ে জাতীয় পার্টি।
জাতীয় পার্টির ভরাডুবি নিশ্চিতের পাশাপাশি পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। আর সুযোগ বুঝে হায়ারিং প্রার্থী দলকে গুডবাই জানিয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে তার যোগদান ও প্রার্থী করার পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দিয়ে যান। তার সেই বক্তব্যে উঠে আসে এরশাদের চারপাশে থাকা কিছু নেতার আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ।
হরহামেশাই উঠছে এসব অভিযোগ। পার্টির মধ্যে একটি কথা চাউর রয়েছে, এসব হায়ারে নাকি কেউ কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হন। যার ফলে যোগদানের আগেই তার মনোনয়ন নিশ্চিত করা হয়। যে কারণে দিনে দিনে তৃণমূলে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। অনেকেই কেন্দ্রের এই ভূমিকার কারণে আর দলে জোরালো ভূমিকা নিতে চাচ্ছেন না।
অন্যদিকে যারা আসছেন তারাও এক সময় নিষ্ক্রিয় হচ্ছেন। অথবা সুযোগ বুঝে দল থেকে কিছু নেতাকর্মী নিয়ে সটকে পড়ছেন। এতে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের শূন্যতা।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের বাংলানিউজকে বলেন, হায়ার-ফায়ারের সবক্ষেত্রে ভুল হয়েছে এমন বলা যাবে না। আবার সব ক্ষেত্রে সঠিক হয়েছে এমন দাবিও করবো না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিলেকশন ভুল হয়েছে এটা মানতেই হবে। অনেক এলাকায় সঠিক প্রার্থী থাকে নাকায় সে ক্ষেত্রে যোগদান করানো হয়।
কিছুক্ষেত্রে তৃণমূলের সঙ্গে সমন্বয় হয় না। ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ হন, দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেও মন্তব্য করেন জিএম কাদের।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৮
এসআই/এএ/