ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মোগল কীর্তিতে ভরপুর দিল্লি

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১২
মোগল কীর্তিতে ভরপুর দিল্লি

দিল্লি বেড়াতে গেছি বেশ ক’বার। সম্প্রতি দিল্লি ভ্রমণে এবার সফরসঙ্গী হলো আমারই ছেলে ‘অলি শাহরিয়ার হাসান’।

ঢাকা থেকে কলকাতায় গিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেসে উঠলাম।

১৮ ঘণ্টা পরে সকাল ১০টায় এসে পৌঁছলাম দিল্লিতে। নিউ দিল্লির পাহাড়গঞ্জে নেমে সেই চিরচেনা দৃশ্য খুঁজে পেলাম। রিকশাওয়ালা, কুলি, দালালরা পিছু লাগলো। সবাই বলছে হোটেলে পৌঁছে দেবে।

ওদের দিকে না তাকিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। পরিচিত সেই হোটেল ‘সান’-এ গিয়ে উঠলাম। দিল্লি তো এখন ভারতের জাতীয় রাজধানী অঞ্চল নামে অভিহিত।

একজন লে. গভর্নরের শাসনাধীন। কিন্তু মন্ত্রিসভাও আছে এখানে। দিল্লিতেই জেলার সংখ্যা ৯। শহরের সংখ্যা ৬২। গ্রামের সংখ্যা ১৫৮। এখানে বিমানবন্দর- ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পালাম আর সফদরজং। দিল্লি শহরে মেট্রো রেলও রয়েছে।

হোটেলে বসে বারবার মনে পড়ছিল দিল্লির মসনদে থাকা মোগল শাসকদের কথা। বাবর, হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহ্জাহান, আওরঙ্গজেব নামগুলো।

তাদের শাসনামল তো ছিল ১৫২৭ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত। বিকেলে গেলাম লালকেল্লার বিপরীতে চাঁদনি চকে। ওখানে গিয়ে গাইডের মুখে শুনলাম ১৬৪৮ সালে শাহ্জাহান কন্যা জাহানারা বেগমের হাতে গড়া ইতিহাসখ্যাত চাঁদনি আজ দিল্লির অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা।

চাঁদনি চক দেখে স্কুটার নিয়ে চললাম হুমায়ূনের সমাধি সৌধ দেখতে। তখন বিকেল ৫টা। পুরনো কিল্লার দক্ষিণে মঙ্গুরা রোডের বামে ১৫৬৫ সালে দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ূনের মৃত্যুতে হাজী বেগম স্বামীর মৃত্যুর ৯ বছর পর সমাধিতে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪৩ মিটার উঁচু অষ্টকোণি সুরম্য সৌধ গড়েন।

পরবর্তীকালে হুমায়ূনের স্ত্রীও সমাধিস্থ হন এখানে। একজন বৃদ্ধের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি এসেছেন পাঞ্জাব থেকে। তিনিই জানালেন, তাজমহলের পূর্বসূরি এটি। উত্তরকালে তাজমহল তথা নানা মোগল সৌধ তৈরিতে প্রেরণাও যোগায় এই হুমায়ূনের সমাধি সৌধ।

উঠতেই বামে দেখলাম দারা, সুজা ও মুরাদের সমাধি। এরা তো শাহ্জাহানের পুত্র। এমনকি পুত্র ও নাতিসহ শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহও শায়িত রয়েছেন এখানে। এছাড়া মদিনার অনুকরণে নির্মিত মসজিদটিও দেখে নিলাম।

হুমায়ূনের সমাধির অপরদিকে সংকীর্ণ গলিপথে লোদি স্থাপত্যে গড়া হজরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার মাজার। সেদিন ছিল শুক্রবার। দেখি কাওয়ালি সঙ্গীতের আসর বসেছে সমাধিতে।

চিস্তি সাম্প্রদায়ের চতুর্থ গুরু শেখ নিজামউদ্দিন ৯২ বছর বয়সে ১৩২৫ সালে মারা গেলে সমাধিস্থ হন এখানে। এখানেই দেখলাম আলাউদ্দিন খিলজির মসজিদ, উর্দু কবি মির্জা গালিব, আমির খসরু, স্থপতি ঈশা খান ও শাহ্জাহান কন্যা জাহানারার সমাধি।

দেখে মনে হলো, এসব যেন রাজকীয় সমাধিভূমি। একটু দূরে পায়ে হেঁটে গিয়ে দেখে নিলাম সূফী সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু হজরত ইলায়েৎ খানের সমাধি। সন্ধ্যা তখনও হয়নি। আবার ফিরে এলাম হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে।

চারদিকে তখন আলো জ্বলে উঠলো। শাহ্জাহান কন্যা জাহানারার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছবি তুললাম। ছবিগুলো তুলে দিলো ছেলে অলি শাহরিয়ার হাসান। মাজারের সামনে এসে মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে কাওয়ালি সঙ্গীত শুনে প্রধান সড়কে এসে উঠে স্কুটার ধরে হোটেলের দিকে ফিরে চললাম।

পরদিন ট্যুরিস্ট বাসে উঠে দিল্লি শহর দেখতে বের হলাম। সঙ্গে আমার ছেলে- এছাড়া বাস ভরা ট্যুরিস্ট। সকাল ৯টায় বাস ছাড়লো পাহাড়গঞ্জ থেকে।

একে একে দেখানো হলো লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, বিড়লা মন্দির, কালীবাড়ি, বাহাই উপাসনা গৃহ, ইন্ডিয়া গেট, রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ ভবন, যন্তর মন্তর, জাতীয় মিউজিয়াম, নেহেরু মিউজিয়াম, ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ি। ইন্ডিয়া গেট দেখার সময় জানলাম, এটি ১৯৩১ সালে তৈরি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৯০ হাজার ভারতীয়  সেনার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি ওয়্যার মেমোরিয়াল আর্চ নামেও খ্যাত এটি।

এর পাশেই দেখলাম খাল কেটে জলপথে সংযোগ ঘটেছে মহাকরণ পর্যন্ত। বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে এখানে। এরই চারপাশ ঘিরে সেক্রেটারিয়েট ভবন, পার্লামেন্ট ভবন আর রাষ্ট্রপতি ভবন।

দুপুরের দিকে বাস এসে পৌঁছল কুতুব মিনারে। এখানে ২ ঘণ্টা বাস রাখা হবে। খাওয়া-দাওয়া আশপাশে সেরে নেওয়ার জন্য বললেন গাইড। দিল্লি শহর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দক্ষিণে এই কুতুব মিনার।

কুতুব উদ্দিন আইবেকের ভারত বিজয়ের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে কুতুব উদ্দিনের হাতে নির্মাণ শুরু, শেষ হয় ১২৩৬ সালে কুতুব উদ্দিনের জামাতা ইলতুৎমিশের হাতে।

বারবার তাকিয়ে দেখছি কুতুব মিনার, তবুও দেখার ইচ্ছে শেষ হয় না। একজন গাইড জানালেন এই মিনারটি পাঁচ তলায় গড়ে উঠেছে। প্রথম তলাটি লাল বেলে পাথরে কুতুবের হাতে। ২য় ও ৩য় তলা দুটি লাল বেলে পাথরে ইলতুৎ মিশের গড়া। আর ৪র্থ ও ৫ম তলা দুটি হয়েছে বেলে পাথর ও মর্মরে ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে।

samadhiকুতুব মিনার দেখার পরে এলাম কুওয়াত উল ইসলাম মসজিদ দেখতে। এরপর দেখলাম আলাই মিনার, ইলতুৎমিশের সমাধি ও আলাউদ্দিনের সমাধি। কুতুব মিনার দেখানোর পরে বাসে উঠলাম। এবার চললাম মাসুদের সমাধি দেখতে। মাসুদ হলেন ইলতুৎমিশের ছেলে।

মাসুদের সমাধির পাশেই দেখলাম খিরকি মসজিদ। এদিকে বিকেল ৪টা বেজে গেছে। বাস এবার চললো রাজঘাটের দিকে। বাসে বসে গাইড দুষ্টুমির ছলে বললেন, রাজঘাটে নেমে ‘ফটাফট’ সব দেখে নেবেন। আবারও বললেন, ‘ফটাফট’। কথাটা শুনে বাসের সব ট্যুরিস্ট হেসে উঠলো।

রাজঘাটে এলাম। গাইড বললেন, যমুনা কিনারে গড়ে উঠেছে অবিস্মরণীয় জাতীয় মন্দির। ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীর শেষকৃত্য হয় এই রাজঘাটে। ঢুকেই দেখবেন, স্মারকরুপে কালো মর্মরে বর্গাকার সমাধি বেদি।

খোদিত হয়েছে গান্ধীজীর শেষ উক্তি ‘হে রাম। ’ গান্ধীর সমাধি বেদিটি দেখে বারবার তাকিয়ে রইলাম। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসে তাকে হত্যা করলো। আর পরদিন এখানে গান্ধীর শেষকৃত্য হলো তারপর কত না বছর চলে গেল। আহা এই তো মানুষের জীবন।

এক সকালে রওনা দিলাম লাল কিল্লা দেখতে। আগ্রা থেকে দিল্লি এসে মোগল সম্রাট শাজাহান গড়ে তুললেন মোগলি স্থাপত্যে লাল বেলে পাথরে কেল্লা বা দুর্গ। নামটিও তাই লাল কেল্লা।

১৬৩৮ সালে শুরু হয়ে ১৬৪৮ সালে কেল্লা নির্মাণ শেষ করান সম্রাট। দুর্গের অভ্যন্তরে এবং এর আশপাশে দেখলাম লাহোর গেট, কাশ্মীরি গেট, দিল্লি গেট। দক্ষিণের দিল্লি গেট হয়েই পথ গিয়েছে জুম্মা মসজিদের দিকে।

এই লাল কেল্লাকেই ঘিরে গড়ে উঠেছিল সেকালের শাহ জাহানাবাদ অর্থাৎ শাহ্জাহানের রাজ্যপাট আজকের পুরনো দিল্লিতে। লাল কেল্লায় আরও দেখলাম কিল্লাই মুবারক, দেওয়ানি খাস, ময়ূর সিংহাসন, রঙ মহল, শিশ মহল, মোতি মসজিদ, খাস মহল, মোগল উদ্যান, দেওয়ানি আম, নহবত খান ইত্যাদি।

দেওয়ানি খাস দেখে তো মুগ্ধ হলাম। মুগ্ধ তো হওয়ারই কথা। এখানে দেওয়ালে পার্সি ভাষায় সোনালি হরফে লেখা দেখে তাকিয়ে রইলাম। পিঠে হাত দিলেন এক বৃদ্ধ, তিনি এসেছেন কলকাতা থেকে। তার মুখেই শুনলাম, ‘এই পার্সি ভাষায় লেখার কথাগুলো বাংলায় হলো- ‘বেহেশতের নহর বা স্বর্গোদ্যান নদী। পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে সে এখানে, সে এখানে, সে এখানে। ’

কথাগুলো শুনে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। জোহরের আজান দিতেই বৃদ্ধ বললেন, চলুন জুমা মসজিদে, ওখানে গিয়ে নামাজ আদায় করবেন। পায়ে হেঁটে এলাম মসজিদের সামনে। বৃদ্ধ জানালেন, এই জুমা মসজিদকে স্থানীয়রা বলেন, জুম্মা মসজিদ। এটি ১৬৫০ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে মোগল সম্রাট শাহ্জাহান তৈরি করান।

এই জুমা মসজিদটির ইমাম পদটি অলঙ্কৃত করছেন বংশ পরম্পরায় শাহ্জাহানের নিয়োগ করা ইমাম পরিবার। মসজিদে ঢুকে নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর মনে হলো, দিল্লি দেখা তো এবারও সফল হলো। তবে এই মসজিদে নামাজ পড়ে যে আনন্দ পেলাম তা কী এ জীবনে আর কোনদিন ফিরে আসবে?

বাংলাদেশ সময় : ১৯৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২,  ২০১২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর  
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।