ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

শিশুর মুখে প্রথম ভাষা

মাইনুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৩
শিশুর মুখে প্রথম ভাষা

কথা না বলে আমরা কতো সময় থাকতে পারি? ভোরবেলা ঘুম থেকে জাগা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত কতো যে কথা বলি তার কোনো হিসেব নেই। শুধু কি জেগে থাকা অবস্থায়? ঘুমন্ত অবস্থায়ও আমরা কখনও কখনও কথার জাবর কাটি।

তাই আর যাই হোক, কথা না বলে আমাদের একটি মুহূর্তও থাকা সম্ভব নয়।

এখন একবার চিন্তা করো, জন্মের পর থেকে একটি শিশু কথা বলার জন্য কেমন আকুল হয়ে থাকে। তার মনে জমে থাকা কথাগুলো বলার জন্য সে কী চেষ্টা তার! যাই ভেবে থাকো, তুমি, আমি, আমরা সবাই-ই শিশুকাল থেকেই ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বলতে পারো একটি শিশু ঠিক কখন থেকে কথা বলতে শুরু করে? তার কথা বলার প্রাথমিক স্তরগুলো কেমন থাকে? আর কীভাবেই বা ধীরে ধীরে সে অনর্গল কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করে? তবে শোনো-

একটি শিশু যখন পৃথিবীতে জন্ম নেয়, তখন সে কী করে? ছোটো ছোটো হাত পা আর পিটপিটে চোখের ছোট্ট মানুষটি বলতে গেলে সারাক্ষণই ঘুমের দেশে থাকে। মাঝে মাঝে একটু আধটু কেঁদে ওঠে। যেনো বলতে চায়, আমি কিন্তু ঘুমুচ্ছিনা! ঘুমের ভান ধরে আছি।

এই ছোট্ট শিশুটিই ধীরে রপ্ত করে কীভাবে তার বাবা-মা আর কাছের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। কিছু না বলেও সে বুঝিয়ে দিতে থাকে মনের কথা। একটু একটু করে সে ধ্বনি উচ্চারণ করতে শুরু করে। শুরু করে আধো আধো কথা বলতে। কখনও কখনও আমরা তার এই উচ্চারিত ধ্বনি বা শব্দ শুনে কোনো অর্থই করতে পারিনা। আবার কখনও মনে হয় এই বুঝি বাবা বলতে চাইল। আবার কোনো ধ্বনি শুনে বলি, সে নিশ্চয়ই মা বলে ডেকেছে। আবার কখনও তার উচ্চারিত ধ্বনিটি তোমার আমার নামের প্রথম ধ্বনিটির সঙ্গে মিলে গেলে মনে করি- সোনামণির সঙ্গে আমার বেজায় ভাব হয়েছে। তাই সে আমার নাম ধরে ডাকছে।

এভাবে বাবা, মা, দাদা, চাচা, মামা, বুবু, ভাইয়া, আমরা যারাই তার কাছে থাকিনা কেন, সবাইকেই সে কখনও না কখনও মাত্র একটি ধ্বনি শুনিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়। দিনে দিনে এই ছোট্ট সোনামণি শব্দ বলে, বাক্য বলে, প্রশ্ন করে, সুর করে কথা বলতে শুরু করে।

একটি শিশু জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এক-আধটু যোগাযোগ করতে শেখে। এ সময় কান্নাই তার ভাষার কাজ করে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, মলমূত্র ত্যাগ, এবং যে কোনো অসুবিধা বোধ হলেই সে কান্না করে। দুধ পান করার সময়ও সে এক ধরনের শব্দ করে। যার মাধ্যমে মা বুঝতে পারেন তার সন্তানের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। তবে এ ধ্বনি বা শব্দগুলো সবসময় সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যায় না। শিশুর এ অবস্থাটা চলতে থাকে জন্মের পর প্রথম আট সপ্তাহ অর্থাৎ দুই মাস পর্যন্ত।

শিশুর বয়স যখন দুই মাস পার হয়, তার ধ্বনি উচ্চারণে বেশকিছু পরিবর্তন আসে। এসময় প্রথম সে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির মতো এক ধরনের ধ্বনি উচ্চারণ করে।

তোমরা নিশ্চয়ই জানো, যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস থেকে আগত বাতাস মুখের মধ্যে কোথাও বাধা পায় না, তাকে স্বরধ্বনি বলে। যেমনÑ অ, আ, ই, উ, ও, এ, অ্যা ইত্যাদি। আর ব্যঞ্জন ধ্বনি হলো সেই সব ধ্বনি, যা উচ্চারণের সময় ফুসফুস থেকে আগত বাতাস মুখের বিভিন্ন স্থানে বাধা পায়। যেমন, ক, চ, ট, ত, প ইত্যাদি। শিশু এসময় স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির মিশ্রণে যেসব ধ্বনি উচ্চারণ করে তার অর্থ উদ্ধার করা একরকম অসম্ভব। যেমন, গা, গ্যা, গু ইত্যাদি। শিশুর বয়স যখন চার মাসের মতো হয়, তখন সে প্রথম শব্দ করে হাসতে শুরু করে। এ সময় কথা বলার জন্য তার মুখের যন্ত্রগুলো ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে থাকে।

৪/৫ মাস বয়সে শিশুর এই স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির একত্রে উচ্চারণের হার বাড়তে থাকে। আর বাড়তে থাকে ধ্বনি উচ্চারণে তার গলার শক্তিও।

শিশুর বয়স পাঁচ-ছয় মাস হলে তার কথা বলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আসে। পূর্বে শিশু যেসব ধ্বনি উচ্চারণ করতো, এসময় সেসব ধ্বনির একটির সঙ্গে আরেকটির জোড়া লাগিয়ে কিছু নতুন ধরনের ধ্বনি উচ্চারণ করে। যেমন, মা, বা, গা ইত্যাদি।

আবার কোনো কোনো ধ্বনি সে বারবার উচ্চারণ করে। যেমন, বা-বা-বা ইত্যাদি। এসময় তার উচ্চারিত ধ্বনি ভাষার কোনো কোনো শব্দের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। শিশুর ভাষা বিকাশের এ স্তরটিকে বলা হয় অস্ফুটভাষা। ইংরেজিতে বলা হয় ব্যাবলিং। এটি চলতে পারে ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত।

শিশুর জন্মের প্রথম বছরের শেষ ভাগে এবং দ্বিতীয় বছরের প্রথম ভাগে বাবা-মা’র ব্যবহৃত ভাষার বিভিন্ন শব্দ বলতে শুরু করে। এসময় সে তার চারপাশের পরিচিত মানুষের নাম, বস্তুর নাম অস্পষ্ট করে হলেও বলতে পারে। শিশুরা এ সময় তার কাছের মানুষদের বা কোনো প্রাণী বা বস্তুর (চাঁদ, তারা, বল ইত্যাদি) নাম ধরে ডাকতে পারে।

আবার এ বিষয়ে প্রশ্নও করতে পারে। এ বয়সের শিশুরা একটি শব্দ দিয়ে একাধিক বস্তু বুঝিয়ে থাকে।
কটি ইংরেজ শিশু এ বয়সে কী করে জানো? সে কেবল ‘ডগি’ (doggie) শব্দ দিয়ে কুকুরসহ এ জাতীয় অন্যান্য প্রাণীকেও বুঝিয়ে থাকে। নিশ্চয়ই ভাবছো, ইংরেজ শিশুটি বোকা! না সে বোকা নয়। কারণ, এ বয়সে পৃথিবীর সব ভাষার শিশুরাই এমনটি করে থাকে।

জন্মের দ্বিতীয় বছরেই শিশু এক শব্দের বাক্য বলতে শুরু করে। এতে ক্রিয়াবাচক শব্দটি থাকে না। যেমন, ‘আম্মু মাম (পানি) দাও’ না বলে সে শুধু ‘মাম’ শব্দটি উচ্চারণ করে। যার অর্থ, ‘আম্মু মাম (পানি) দাও। ’ টেলিগ্রাফে এরকম একটি-দুটি শব্দ ব্যবহার করে তথ্য পাঠানো হয় বলে, শিশুদের এই এক শব্দের ব্যবহারকে টেলিগ্রাফিক শব্দ বলা হয়।

এভাবেই শিশুরা ধীরে ধীরে দুই শব্দ, তিন শব্দ করে বড়ো বাক্য বলতে শেখে। অনর্গল কথা বলতে শেখে, তোমার নাম জিজ্ঞেস করে, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়। আর এক সময়ের ছোট্ট শিশুটি তোমার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে অবাক করে দেয়। কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তুমিও এভাবেই কথা বলতে শিখেছো। আমিও তাই।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।