নিজের দেশকে অস্বীকার করে যারা বিদেশি হানাদারের সঙ্গে হাত মেলায়; যারা নিজ দেশের নাগরিক হত্যা করে; তারা দেশদ্রোহী, তারা রাজাকার। প্রাণিজগতে কি এমন আচরণ দেখা যায়? একটি প্রাণি কি নিজ প্রজাতির আরেকটি প্রাণিকে খায়? প্রাণিরা কি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? একটি প্রাণি কি নিজের প্রজাতির প্রাণিকে অন্য হিংস্র প্রাণির হাতে তুলে দেয়? অথবা নিজ প্রজাতির প্রাণিকে কারণে-অকারণে হত্যা করে? চলো দেখা যাক, প্রাণিজগতের কাউকে রাজাকার প্রাণি বলা যায় কি না!
নিজের প্রজাতির প্রাণিকেই খায় এমন নজির প্রাণিজগতে কম নেই কিন্তু! প্রায় ১৫০০ প্রজাতির প্রাণির এমন আচরণ দেখা যায়।
বন্ধুরা, হাঙরের নাম তোমরা নিশ্চয় সবাই শুনে থাকবে। হাঙর কতোখানি হিংস্র সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছু হাঙরের এই হিংস্রতা শুরু হয় মায়ের পেটে বসেই। একটি হাঙর মায়ের পেটে তার ডিম ফুটে একাধিক বাচ্চা হয়। সবচেয়ে শক্তিশালী আর বড়ো বাচ্চাটি তখন ছোট বাচ্চাগুলোকে খাওয়া শুরু করে। এমন আচরণ দেখা যায় ফায়ার স্যালামান্ডার নামক এক উভচর প্রাণিতেও।
শিম্পাঞ্জিরা বেশ সামাজিক। তারা নিজেরা কতোগুলো গোষ্ঠী বা পরিবারে বিভক্ত। নিজের গোষ্ঠীর শিশুদের প্রতি তাদের যে স্নেহ, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়, তা মানুষের মতোই। তবে এই ভদ্র প্রাণিটি কখনো অভদ্র হয়ে ওঠে। পুরুষ শিম্পাঞ্জির সংগঠিত দল মায়ের বুক থেকে বাচ্চা শিম্পাঞ্জিকে অপহরণ করেছে এবং সেটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এমন নজির অনেক রয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো, তারপর তারা সেটিকে খেয়েছে।
কালোমাথা গাঙচিল (Black-headed Gull) অন্য গাঙচিলের মতোই সাগর থেকে মাছ শিকার করে জীবনধারণ করে। সাগরের তীরে একসঙ্গে অনেকগুলো গাঙচিল পরিবার বাসা করে। তৈরি করে ফেলে একটি কলোনি। কলোনির সব বাচ্চারা থাকে একসঙ্গে। বাচ্চাদের মা-বাবা খাবার নিয়ে আসতে ছোটে সমুদ্রে। কিন্তু কয়েকটি গাঙচিল খাবার আনতে যায় না। যাদের বাবা মা দু’জনই খাবার আনতে গেছে এমন বাচ্চা গাঙচিল খোঁজে। সুযোগ বুঝে একটাকে খপ করে ধরে গলার মধ্য পুরে নেয়। বাবা মা বাসায় খাবার নিয়ে আসে। বাচ্চাকে না পেয়ে হাহাকার করে। এমন আচরণ সত্যিই মেনে নেয়া যায় না। কি বলো?
এদিকে ক্যানিব্যালিজমের চর্চা থাকায় বিপদে পড়ে যুবক মাকড়সারা। যুবতী মাকড়সাকে প্রেম নিবেদন করতে গেলে নিজের জীবন হারাতে হতে পারে, এমন সম্ভাবনা নিয়েই তারা যায়। এমন আচরণ দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির বৃশ্চিকে; বিভিন্ন রকমের মাকড়সাতে। এদিকে বেচারা ছেলে ম্যান্টিস ফড়িঙরা প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে কখোনোই বেঁচে ফিরতে পারে না।
ক্যানিব্যালিজম ছেড়ে এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। সমুদ্রে মাছ আছে অনেক ধরনের। এদের একটি মাছ হলো ক্লিনার ফিশ বা পরিষ্কারক মাছ। এই মাছগুলো বড়ো বড়ো মাছের মুখ আর ফুলকার ময়লা পরিষ্কার করে। অর্থাৎ, সেখানখার ময়লা আর পরজীবী খেয়ে থাকে। বড়ো মাছগুলোও তাদের মুখ হা করে থেকে তাদের এই কাজে সাহায্য করে। কখনো তারা এই ক্লিনার মাছদের খায় না। তবে কোনো ক্লিনার মাছ পরজীবী খেতে এসে উল্টো করে কি, বড়ো মাছটির আঁইশ, চামড়া এসব খেয়ে ফেলে। বড়ো মাছটির জন্য এটা বেশ ক্ষতিকর।
শকুন যে মৃতভোজী এটা আমরা জানি। তাই শকুনকে দেখে জীবিত কোনো প্রাণি ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে না। তুর্কি শকুনরাও তেমন। তবে এদের দেখে ইঁদুর বা খরগোশ যদি ভয় পেয়ে গর্তে না ঢোকে তাহলেই বিপদ! তুর্কি শকুনের ঝাঁকে মিশে থাকে একই রকম দেখতে এক ধরনের বাজপাখি (Zone-tailed Hawk)। মুহূর্তেই বাজপাখিটি অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে শিকার করবে ওদের।
প্রাকৃতিক বিশ্বাসঘাতকতার আরেকটি উদাহরণ জোনাকি। জোনাকি পোকা আলো দিয়ে অন্যদের সংকেত পাঠায়। জোনাকির অনেকগুলো প্রজাতি। একটি আছে শিকারী প্রজাতি। তারা আবার অন্য প্রজাতির মেয়ে জোনাকির মতো আলো জ্বালায়। অন্য প্রজাতির ছেলে জোনাকি যখন সেই সংকেত ধরে কাছে আসে, বুঝতেই পারছো, তখন নিজারাই খাদ্য হয় তারা।
বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে শুধু প্রাণিরা, তা নয়। কিছু গাছও পারে। কিছু অর্কিডে তেমন একটা মধু নেই। মৌমাছি তাই কাছে ঘেঁষে না। তবে, এক ধরনের অর্কিড দেখতে একদম মেয়ে মৌমাছির মতো। বোকাসোকা ধরনের ছেলে মৌমাছি এসব ফুলের কাছে গিয়ে ধোঁকা খায়। এমনকি, এসব অর্কিডের পরাগায়নে সাহায্য করে থাকে। বেচারাদের গার্লফ্রেন্ড তো জোটেই না, মধুও জোটে না।
তবে, ধোঁকা দেবার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ সৃষ্টি করে ডাহুক পাখি। একটি পুরুষ পাখি অন্য আরেকটিকে সহ্য করতে পারে না, সে ব্যাপারটি মানুষ কাজে লাগিয়েছে। ডাহুক পাখিকে পোষ মানিয়েছে। ডাহুক পাখি পোষও মানে ভালো। এই পোষা ডাহুককে ব্যবহার করা হয় বুনো ডাহুক ধরার জন্য। বনের পাখিকে ধরার জন্য খাঁচার পাখিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। খাঁচার পাখির সঙ্গে বুনোটা মারামারি করতে আসলেই, তার পা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে খাঁচার পাখিটি। পা আঁকড়ে ধরতে পারলে, খাঁচার পাখির মালিক এসে বনের পাখিটি ধরতে পারে। খাঁচার পাখিটি তখন মানুষটির কাঁধে উড়ে গিয়ে বসে। মানুষ ডাহুকের মাংস খায়, ডিমও খায়। অথচ পোষা ডাহুকের কাছে সেই মানুষ এতো আপন যে নিজের স্বজাতিকে সে মানুষের হাতে তুলে দেয়।
তবে প্রাণিরা যতোই বিশ্বাসঘাতক হোক, তাদের সব আচরণের মাঝেই সোজা-সাপ্টা সারকথা: বাঁচতে হবে, সে যেভাবেই হোক না কেনো। তারা কখনোই মানুষের মতো বুদ্ধিমান নয়, চালাক-চতুর নয়। কোনো প্রাণির মাঝেই মানুষের মতো সামাজিক বোধ জন্মায়নি, মানবিকতা জন্মায়নি। কিন্তু তার পরেও, কারণে-অকারণে কোনো মানুষ অন্য প্রাণিদের, এমনকি হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। এমনকি সেজন্য অনুশোচনাতেও ভোগে না। কিন্তু এমন মানুষকে কি তোমরা সমাজে চাও? নিশ্চয়ই নয়। আর আমাদেরও মানবিক হতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]