-শিমু, শিমু! ওঠো! কত আগে সকাল হয়ে গেছে! ডাকলেন মা।
শিমু পাশ ফিরে শোয়।
শিমু এবার লাফ দিয়ে উঠে বসল। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, তুমি আমাকে জীবনেও শান্তি দিবে না। তুমি না থাকলেই আমার ভালো হতো। কী এক পেয়েছ তো পড়াশুনা। আমার পড়া, আমি পড়ব কী পড়ব না আমার ব্যাপার। তোমার কী? আশ্চর্য!
রাগে গজগজ করতে করতে বিছানা ছেড়ে উঠে হাত-মুখ ধুতে গেল শিমু। মা শুধু ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
হাতমুখ ধুয়েই শিমু ল্যাপটপটা খুলে বসল। গেইম খেলবে আর বন্ধুদের সাথে চ্যাট করবে। এর মধ্যে মা খেতে ডাকলেন। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে শিমু তার মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচি করল। তারপর ফের মনোযোগ দিল ল্যাপটপে। মা আরো কয়েকবার ডাকলেন। শিমু পাত্তা দিল না। মা অনেকক্ষণ অনুনয়-বিনয় করার পর বিরক্তি সহকারে শিমু খেতে বসল। মা তার প্লেটে যত্ন করে একটা হাতে গড়া রুটি আর তরকারি তুলে দিলেন। নাস্তা দেখে শিমু নাক-মুখ সিঁটকে বলল, এটা কী? আমি এসব হাবিজাবি জিনিস খেতে পারব না। আমাকে স্যান্ডউইচ দাও।
-আজ তো ঘরে পাউরুটি নেই, তাই একটা দিন না হয় রুটি খাও। বিকেলে পাউরুটি আনিয়ে স্যান্ডউইচ করে দেব।
-কী? আমাকে এটা খেতে হবে? এই বিচ্ছিরি রুটি? আমি খাব না। কোনোভাবেই খাব না। খাবার রেখে উঠে গেল শিমু। মা পেছন পেছন রুটি নিয়ে শিমুর দিকে এগোলেন।
-শিমু, মা লক্ষ্মী, প্লিজ আজকের জন্য একটু কষ্ট করে এটুক খাও। না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে তো মা। শরীরটা খারাপ লাগছিল, তবুও আমি সেই কোন ভোরে উঠে তোমার জন্য রুটি বানিয়ে তরকারি রেঁধে রাখলাম।
কেন রেঁধেছ? কেউ রাঁধতে বলেছিল তোমায়? মুখ বাঁকিয়ে বলে শিমু। তারপরও মা তার পিছু পিছু রুটি-তরকারি নিয়ে সাধাসাধি করলেন।
শিমুর এত বেশি রাগ হলো যে সে মায়ের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে সশব্দে ছুড়ে ফেলল। চিনামাটির প্লেটটা ঝন ঝন করে গেল ভেঙে। আর মেঝেতে ছড়িয়ে রইল রুটি আর তরকারি।
মা মুখে আঁচল চাপা দিলেন। কিচ্ছুটি বললেন না। তাঁর চোখের কোণে শুধু একটুখানি জলের রেখা দেখা গেল।
কয়েকদিন ধরেই শিমুর শরীরটা খুব খারাপ। জ্বর-মাথাব্যথা। কেমন কেমন যেন লাগে। বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারে না সে। মা সারাক্ষণ তার মাথার পাশে বসে থাকেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। শিমুর এসব একদম সহ্য হয় না। সে তার বান্ধবীদের ফোন করে বলেছে তারা যেন আসে। তাদের সাথে গল্প করতে শিমুর খুব ভালো লাগে। আর মাকে খুব বোরিং লাগে। কিন্তু ওর কোন বান্ধবী আসেনি। শিমুর খুব অবাক লাগে। শিমুর এত্ত ভালো বান্ধবী ওরা, আর একটিবারের জন্য তাকে দেখতেও এলো না?
মা অবশ্য শিমুর রাগারাগি সত্ত্বেও এক মুহুর্তের জন্যও ওর পাশ থেকে সরেন না। শিমুর খুব রাগ হয়। কিন্তু সে কিছু বলে না। কারণ প্রচন্ড মাথাব্যথার সময়টায় মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে বেশ আরাম লাগে। আর তাছাড়া এখন তো শিমুর নিজে নিজে খেতেও কষ্ট হয়। মা খাইয়ে দিলে খারাপ লাগে না।
দুপুরে শিমুকে শোয়া অবস্থায় রেখে মা রান্নাঘরে গেলেন। শিমু চুপচাপ শুয়ে রইল। মাথাটায় খুব যন্ত্রণা করছে। হঠাৎ টেবিলে রাখা টেবিল ক্যালেন্ডারে তারিখটা দেখে শিমু এক মুহুর্তের জন্য চমকে ওঠে। আজকে মা দিবস না? তাতে অবশ্য তেমন কিছু এসে যায় না। প্রতিবছর মা দিবসে শিমুর বান্ধবীরা তাদের মায়েদের এটা সেটা গিফট করে, শুভেচ্ছা জানায়। শিমু কিছু করে না। তার মাকে তার একদম পছন্দ না। তার মা তো আর অন্য সব মায়েদের মতো না। তাকে শুভেচ্ছা জানানোর কী আছে, আর ভালোবাসারই বা কী আছে?
অন্য সবার মায়ের মতো শিমুর মা তো তাকে ঘরতে নিয়ে যেতে পারে না। তাকে কোথাও খাওয়াতেও নিয়ে যেতে পারে না। মাকে নিয়ে কোথাও বের হওয়া যায় না। আর মাকে পরিচয় দিতে লজ্জা করে শিমুর। বাইরের মানুষের কাছে বলতে লজ্জা হয়, ওই পঙ্গু মানুষটি তার মা।
কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে মাকে তার শুভেচ্ছা জানানো উচিত? এতদিন মায়ের প্রতি অবহেলা করে আসার জন্য কেন রাগ হচ্ছে নিজের ওপর? কেন তার এমন উপলব্ধি হচ্ছে?
কোনোদিন মায়ের কোনো কথা শিমু শোনেনি। মাকে শুধুই কষ্ট দিয়েছে। শুধু অবহেলা আর তিরস্কারের পাত্রী ভেবে এসেছে। তবে আজ কেন মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে? শিমু বুঝতে পারে না। হঠাৎ মাথার যন্ত্রণাটা খুব বেড়ে যায়। প্রচণ্ডভাবে ঘামতে থাকে শিমু। চিৎকার করে ডাকে, মা... মা!
রান্নাঘর থেকে মা ঝড়ের বেগে হুইল চেয়ারে করে ছুটে আসেন। এসে দেখেন শিমু ছটফট করছে। মা তার কপালে একটা হাত রাখেন। কী হয়েছে শিমু? কী হয়েছে? খুব কষ্ট হচ্ছে মা? উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন মা। শিমু কিছু বলতে পারে না। কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মায়ের ডান হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে দু’হাতে চেপে ধরে শিমু। খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করে একটা বাক্য- মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি মা।
শিমুর হাত দু’টো আলগা হয়ে আসে। দৃষ্টি হয়ে আসে ঝাপসা। মনে হয় দূর থেকে মা তাকে ডাকছেন, শিমু... শিমু!
অনেক চেষ্টা করেও শিমু উত্তর দিতে পারে না। তার চারপাশের সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।
লেখক: মীম নোশিন নাওয়াল খান, সপ্তম শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]