ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মুক্তিযুদ্ধের গল্প

মা ও ছেলে

চন্দন চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১০
মা ও ছেলে

মা ছেলেকে বলে, ওটা হলো মেঘ!
ছেলে কি বোঝে!
মা ছেলেকে বলে, ওটা হলো গাছ!
ছেলে কি বোঝে!
কিছুই বোঝে না ছেলে! ফুল বোঝে না, নদী বোঝে না। তাহলে কী বোঝে!
মা ছেলেকে বলে, ওটা হলো পাখি!
পাখি ডেকে ওঠে।

ছেলের চোখ দুটি সেদিকে যায়। মা হি হি করে হাসে, এই তো ছেলে বুঝেছে! এই তো ছেলে চিনেছে।
কিন্তু ছেলেটা কি চেনে, বোঝে! অত্তটুকু ছেলে, বছর হলো না বয়স। এই ছেলে আর কী বোঝে! ফুল দেখে তাকিয়ে থাকে, পাখির ডাক শুনে মাথাটা নাড়ে, চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়। তবু মায়ের এক কথা, ছেলেটা তো বুঝতে শিখে যাচ্ছে।
মা বলে, বলো দেখিনে, মা বলো!
ছেলেটা অ্যা অ্যা করে।
মা ভেংচি কেটে বলে, অ্যাঁ, অ্যাঁ..
মা হাসে। ছেলেটার নাকে ধরে বলে দুষ্টু, আজ রাতে তোকে চাঁদে নিয়ে যাবো। বুঝলি, সেখানে একটা বুড়ি আছে। বুড়িটা তোকে মাথা থেকে সাদা সাদা চুল খুঁজে দেবে। তুই সেই চুল দিয়ে জামা বানাবি, পারবি না।
মা বলে, ছেলেটা অ্যা অ্যা করে।
ওমা হঠাৎ এই রকম শব্দ হলো কোত্থেকে! কী বিকট শব্দরে বাবা! আত্মাটা কেঁপে ওঠে মায়ের। বুকটা ধুকধুক করে। জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। ক’দিন ধরেই শুনছে দেশে নাকি যুদ্ধ লেগেছে। আগে কোনোদিন যুদ্ধ দেখেনি মা। যুদ্ধ নাকি মন্দ লোকের কাজ। শুধু মারামারি। মেরে ফেলে। শুধু কি মেরে ফেলে! মাও আর কতটুকু জানে! মা ভাবে, তাহলে কী যুদ্ধ এলো! ছেলের বাপ গেছে মাঠে। আচ্ছা, ওখানেও কি যুদ্ধ গেছে! মায়ের বুকটা ধুকধুক করে। এর মধ্যে গাছের পাখিরা উড়ে গেছে। আকাশে চক্কর মেরে অনেক কাক কা কা করছে। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। মা ভাবছে। তবে নিশ্চয়ই যুদ্ধ এসেছে। যুদ্ধ নিশ্চয়ই ডাকুর মতো। মা ছেলেকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে। যুদ্ধ এলে কী হবে! মা জানে না। ছেলেও জানে না। মা ভাবে, তারা জানবে কী করে! তারা তো আর মন্দ লোক নাÑতাই জানে না।
দ্রুম দ্রুম শব্দগুলো একেবারে তাদের উঠানে এসে গেছে। মা ভয় পায়, ছেলেও ভয় পায়! ছেলে মায়ের বুকের কাপড় আঁকড়ে ধরে। ঘরের সামান্য পেছনের কেওড়া গাছের নিচে আশ্রয় নেয় মা। কয়েকটা মানুষ তাদের ঘরে ঢুকেছে। ঘরে শাশুড়ি। একা। ভালো করে হাঁটতেও পারে না। লোকগুলো তাকে উর্দু ভাষায় বকাঝকা করে কথা বলছে। মা ভাবে, যুদ্ধ নিশ্চয়ই উর্দু ভাষায় শাশুড়িদের বকাঝকা। কিন্তু লোকগুলো তার শাশুড়িকে লাথি মারে। বুড়ো বয়সে অন্তর-ফাটা চিৎকার করে শাশুড়ি। শাশুড়ির কাছে লোকগুলো টাকা-পয়সা গয়না-গাটি চায়। শাশুড়ি ৩০ টাকা দেয়। লোকগুলো আরো বেশি টাকা চায়। মা ভাবে, তাহলে যুদ্ধ মানে মুরুব্বিদের লাথি মেরে টাকা-পয়সা আদায়।
লোকগুলো তার শাশুড়িকে পেটাতে শুরু করে। আর বলে, অ্যা ঘরে মুক্তি হ্যায়! মানে এই ঘরে মুক্তিযোদ্ধা আছে! মা ভাবে তাহলে যুদ্ধ মানে মুক্তিযোদ্ধা খোঁজা।
তারপর হঠাৎ করে লোকগুলোর অস্ত্র গর্জে উঠলো। বুড়ো শাশুড়ি আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করলো। রক্তে তার শরীর ভেসে যাচ্ছে। লোকগুলো তাকে টেনে নিয়ে এলো ওঠানে। শাশুড়ির এই অবস্থা দেখে আর লুকিয়ে থাকতে পারলো না মা। বেড়িয়ে এসে কেওড়া গাছের আড়াল থেকে। চিৎকার করে ধরলো শাশুড়ির নিথর দেহটা।
মা বলে, মা গো যুদ্ধ তো আইস্যা পড়লো।
শাশুড়ি কোনো কথা বলতে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার বৌটির দিকে।
চারজন সেনা শিশুসহ মাকে পেয়ে হেসে উঠলো। একজন বলল, ঘর থেকে টাকা-গয়না বের কর। নয় তো তোর শাশুড়ির মতো তোকেও মেরে ফেলবো।
মা বলে, বিশ্বাস করেন, আমাগো টাকাপয়সা নাই!
তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধা আছে!
না, নাই।
এক সেনা আরেক সেনাকে বলল, দুটোকে একসঙ্গে ক্যাম্পে নিয়ে যাই!
এক সেনা বলল, একটাকে নিলেই আরেকটা আসবে।
কেমন?
শুধু শুধু কষ্ট করে জোরাজুরি করে মহিলাকে ক্যাম্পে নিয়ে কী লাভ! ছেলেটাকে নিয়ে নিলেই মা পেছনে পেছনে আসবে।
মা সেনাদের কথা শুনে আর ভাবে, হায় হায় বলে কী!
মায়ের কোল থেকে এক টানে ছেলেকে নিয়ে যায় এক সেনা। মা বলে, হায় হায়, আমার পোলারে নিলেন কেরে! হেরে আমার কাছে দেন! এত টুকুন দুধের বাচ্চা, হে তো ব্যথা পাইবো!
চার জন সেনা চর্তুভুজ হয়ে দাঁড়ায়। একজন ছেলেকে উঁচিয়ে ধরে। মা তার কাছে দৌঁড়ে যায়। আর তখনই ছেলেটাকে আরেকটা সেনার কাছে উপর দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। মা দৌঁড়ে যায় সেই সেনার কাছে। এভাবে চলতে থাকে। ছেলে কাঁদে, ছোট শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। মা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হয়রান। কিন্ত সেনারা এক আজব খেলায় মেতে ওঠে। মা সেনাদের পায়ে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। কিন্তু ছেলেকে ফিরিয়ে দেয় না সেনারা। মা মাটিতে গড়াগড়ি খায়, আবার ওঠে, সেনাদের কাছে হাত জোর করে টুপকে ফিরিয়ে দিতে বলে। কিন্তু সেনারা এতে আরও মজা পায়। তারা টুপের এক হাত ধরে বাতাসে ঘুরায়। মা দেখে ছোট শিশুটা কেমন জোরে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদছে।
তার চিৎকারে যেন গাছের পাতাগুলো নড়ে ওঠছে।
তার চিৎকারে যেন মাটিও কেঁপে উঠছে। পৃথিবীটা দুলছে। এমনই মনে হচ্ছে মায়ের।
সেনারা এবার ছেলেটাকে নিয়ে হাঁটা দেয়। মাও তাদের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। তারা বাড়ি পার হয়ে যায়, একটা রাস্তা পার হয়ে যায়, ইস্কুল তারপর গ্রাম, তারপর অনেকগুলো জমি পার হয় তারা। মা ছুটছে তাদের পেছনে।
মা বলল, আমাকে মেরে ফেলো তোমরা, আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও।
মায়ের কথায় সেনারা হাসে। তাদের হাসিগুলো আরো তাজা হয়। মা এক সেনার পা আঁকড়ে ধরে। সেনা বিরক্ত হয়। বলে, এটাকে শেষ করে দিই।
একজন বলে, ওকে শেষ করার দরকার নাই।
খুব তো জ্বালাচ্ছে।
অন্য সেনাটি হেসে বলে, আর বেশি জ্বালাবে না।
সামনেই নদী। নদীর জল টলমল করছে। একজন সেনা মায়ের উদ্ধেশ্য করে বলল, তোমার ছেলেকে আমরা মারবো না। এমন পাপ করতে পারবো না আমরা।
মা বললো, তাহলে ফিরিয়ে দাও তাকে।
তোমার ছেলেকে মারবো না। তবে তাকে আমরা পানিতে ফেলে দেব।
কী বলে সেনা! দশ মাসের শিশুকে পানিতে ফেলে দেবে! মা কী বলবে বুঝতে পারে না। মুখটা একেবারে হা হয়ে যায়। ছেলেকে নিয়ে সেনাটি একটি নৌকার গলির ওপর বসে আছে। ছেলেটির এক পায়ে ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পানির ওপর। হাত থেকে ছেড়ে দিলেই ছেলেটা একেবারে পানিতে ডুবে যাবে। পানির ওপর ছেলের ছায়া দেখছে মা।
সেনাটি হো হো করে হাসছে।
মা আবার তাদের বলে, আমাকে তোমরা মেরে ফেলো, আমার ছেলেটাকে মেরো না।
আরো অধিক জোরে হাসে সেনারা।
তাদের হাসি বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। মা বুঝতে পারে তাকে নিয়ে একটি খেলায় মেতে ওঠেছে সেনারা। মা সিদ্ধান্ত নেয়, সেনাদের হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতেই হবে। দৌঁড় দিয়ে নৌকায় উঠতে চায় মা। আর অমনি এক সেনা রাইফেলের বাট দিয়ে মায়ের মাথায় আঘাত করে।
পৃথিবীটা খুব দ্রুত ঘুরছে...
অন্ধকার
অন্ধকার
মিশমিশে কালো
অনেকণ পর, আবার পৃথিবীটা ফর্সা হয়। মা দেখে রক্তে ভিজে আছে সারা শরীর। আশেপাশে কেউ নেই। নৌকাটা নেই, সেনাগুলো নেই। মা হাউ মাউ করে চিৎকার করে। মা মাটিতে হাত চাপড়িয়ে কাঁদে। মা সারা শরীরে ধুলো মেখে উঠে বসে। আকাশের দিকে তাকায়। মেঘ।
নাহ্, তার ছেলে মেঘ চেনেনি।
ওপর থেকে চোখ নামাতেই চোখে পড়ে দূরে একটা গাছ।
মা ভাবে, নাহ্, তার ছেলে গাছ চেনেনি।
মাথার ওপর দিয়ে একটা পাখি উড়ে যায়।
মা ভাবে, তার ছেলেটি পাখি চিনেছিল কি!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।