আমাদের জার্নালিজম কোর্সে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। সাংবাদিকতায় যে ওর খুব আগ্রহ তা দেখেই বোঝা যায়।
তখন থেকে ফোনটা বেজেই চলেছে। আমি গিয়ে ফোনটা তুললাম।
- হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
- ওলাইকুম আসসালাম। আমি তন্ময় বলছি। ওপাশ থেকে বলে উঠল তন্ময় ভাইয়া।
- জ্বী ভাইয়া, আমি তুফান। ভাইয়া, আপনি হঠাৎ…
- হুঁ, কাল তোমাদের জার্নালিজম ক্লাসটা হচ্ছে না। সেটা আজকে বিকেল চারটায় হবে।
- ঠিক আছে ভাইয়া, আমি চলে আসবো।
- আল্লাহ হাফেজ।
- আল্লাহ হাফেজ।
আড়াইটা বাজে। আমি ‘CHILDREN CULTURE INSTITUTE’ -এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তায় যা জ্যাম, এখন না গেলে ক্লাস মিস করব।
পৌঁছে দেখি কেউ আসেনি। ট্রেইনার তন্ময় ভাইয়া ফাইল ঘাঁটছেন আর নিশাত নামের নতুন মেয়েটা ওর মায়ের সঙ্গে অফিস রুমে বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ একটা বিষয় নিয়ে ভাবলাম। সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় লাগল। তারপর অফিস রুমে ঢুকলাম।
- আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। আন্টি আর নিশাত দু’জনই একটু অবাক হলো আমাকে দেখে।
- আন্টি, আমি তুফান। আসলে, নিশাত সেদিন আগের ক্লাসগুলোর লেসন চাচ্ছিল, তাই...
- ও, আচ্ছা। তুমি সেটা মনে রেখেছ সেজন্য ধন্যবাদ। নিশাত, ভাইয়ার কাছ থেকে লেসনগুলো নিয়ে নাও।
একটা অকাজ হয়েছে। সেদিন নিশাতকে লেসন দেওয়া উচিত হয়নি। কারণ, সবাই এজন্য আমার সঙ্গে আড়ি নিয়েছে। যাক, কী আর করা, ভুলতো মানুষই করে! এতদিন অন্যরা নিশাতে পাশে বসত না, ওর সঙ্গে কথা বলত না, ওকে যে গ্রুপে দেয়া হতো সে গ্রুপের কেউই ওর সঙ্গে কাজ করত না, এখন আমিও তাই করি। মেয়েটার সহ্যক্ষমতার প্রশংসা করতে হয়। এখনও তন্ময় ভাইয়ার কাছে নালিশ করেনি।
‘CHILDREN FILM FESTIVAL’ এর জন্য যারা ফিল্ম তৈরি করতে চায়, তাদেরকে আমাদের ইনস্টিটিউট থেকে ক্যামেরাসহ অন্যান্য দরকারি জিনিস দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে। এক্ষেত্রেও নিশাতের বেশ আগ্রহ। ও সেটা তন্ময় ভাইয়াকে বলতেই রাজু বলে উঠল-
- মেয়েদের এসব কাজ করা উচিত না। এগুলো ছেলেদের কাজ, বুঝেছ?
নিশাত চুপ করে রইল। মিজান বলল-
- মডার্ন মেয়েরা এসব মানে না। এদের জন্যই তো দেশের আজ এই অবস্থা।
এবারও নিশাত চুপ। শুভ্র তাল দিয়ে বলল, এসব মেয়েদের এগুলো বলে লাভ নেই। ওরা কথা শোনে নাকি?
- তোমরা চুপ করবে? এতক্ষণ ধরে সব শুনছি। তোমরা যুক্তিহীন সব কথা বলছ। বর্তমানে মেয়েরা অনেক কিছুতেই এগিয়ে যাচ্ছে। নিশাতও পারবে। তোমাদের ওকে এগুলো বলার অধিকার নেই। বললেন তন্ময় ভাইয়া।
- আপনাদের কোর্সটা একটা ফালতু কোর্স! খুব খারাপ! আপনারা সবার জন্য সমান অধিকারে বিশ্বাসী নন! আপনারা সাংবাদিক হতে পারেন না! আমি সবাইকে বলব, আপনারা পচা, পচা, পচা! কেউ আপনাদের পছন্দ করে না! আমি আর আপনাদের সঙ্গে কাজ করব না। একদমে কথাগুলো বলে মাকে টানতে টানতে চলে গেল নিশাত।
সেই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে সাতটি বছর। সেদিনকার সেই ক্ষুদে সাংবাদিকরা আমরা এখন অনার্স, মাস্টার্স পড়ছি। কারোরই তেমন খ্যাতি নেই। তবে এসএসসি পরীক্ষার্থী নিশাত বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। একজন সফল পরিচালক, প্রযোজক এবং সাংবাদিকের নাম- নিশাত আনান।
এখন তন্ময় ভাইয়া, রাজু, মিজান, শুভ্র সহ আমরা সবাই সেদিনের কথা ভেবে আফসোস করি। এখন সবাই নিশাতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে, কিন্তু ও যে আজ ব্যস্ত একজন মানুষ, ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।
আমি চার-পাঁচদিন নিশাতদের বাসায় গিয়েছি। নিশাতকে পাইনি। আন্টি বলেছেন, আজ রমনা পার্কে নিশাতের একটা সিনেমার শ্যুটিং আছে। সকাল থেকেই শ্যুটিং হবে। দুপুর বেলায় শ্যুটিং স্পটে হাজির হলাম। তখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে। ইউনিটের সবাই ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে বসেছে। একজনকে ডেকে বললাম, নিশাতের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সে গিয়ে বলতেই নীল শার্ট-জিন্স পরা একটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আধাপিঠ চুল, চোখে বাদামি ফ্রেমের চশমা। গরমে শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে।
- আমাকে খুঁজছিলেন কী? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল সে।
- হ্যাঁ, তুমি তো নিশাত, তাই না? আমি তুফান, চিনতে পারছ?
- না, ঠিক মনে পড়ছে না। আপনি কোন তুফান?
- তুমি সিসিআই -তে Children journalism বিষয়ে কোর্স করতে না, আমিও সেখান ছিলাম। একবার তোমাকে লেসন দিয়ে এলাম, মনে পড়ছে?
- ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা ভাইয়া আপনি হঠাৎ….
নিশাতের কথা শেষ না হতেই একটা ছেলে ডাক দিল, নিশাত ম্যাডাম, ক্যামেরা রেডি।
নিশাত আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি ভাইয়া, আজ আর সময় নেই। অন্য একদিন কথা বলব। তারপর দৌড়ে চলে গেল।
আমি ফিরে যেতে লাগলাম। কিছুদূর যেতে শুনলাম নিশাতের গলা- লাইটস, ক্যামেরাস, রোল অন, থ্রি... টু... ওয়ান... জিরো... অ্যাকশন!
লেখক: মীম নোশিন নাওয়াল খান
সপ্তম শ্রেণি
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]