ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মহীয়সী হেলেন কেলার

ইমরুল ইউসুফ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৩
মহীয়সী হেলেন কেলার

প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তি মানুষকে যে কোথায় নিয়ে যায় যেতে পারে, তার বড় উদারহণ হেলেন কেলার। হেলেন তার সব শারীরিক অক্ষমতাকে মানসিক শক্তি দিয়ে জয় করে হয়ে উঠেছিলেন একজন চিন্তাশীল-সৃষ্টিশীল মানুষ।

যে মানুষটি সবসময় বলতেন, ‘অন্ধত্ব নয়, অজ্ঞতা ও অনুভূতিহীনতাই দুনিয়ার একমাত্র দুর্ভেদ্য অন্ধকার। ’

বন্ধুরা, হেলেন কেলারের নাম তোমরা অনেকেই শুনেছো। আর এটিও জানো যে, অন্ধ, বোবা, কালা হয়েও জ্ঞানে গুণে এবং তার লেখার মধ্য দিয়ে তিনি একজন বিশ্ব ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। তার জন্ম ১৮৮০ সালের ২৭ জুন আমেরিকার আলবামা রাজ্যের তাসকাম্বিয়া শহরে। শৈশবে হেলেন স্বাভাবিক শিশুদের মতোই ছিলেন। এক বছর বয়সে হাঁটতে শেখেন। দুএকটি কথাও বলতে পারতেন। তার চটপটে স্বভাবের জন্য বাবা আর্থার এইচ কেলার ও মা কেট এডামসের আনন্দের সীমা ছিল না।

কিন্তু এমন অবস্থা এমন আনন্দ বেশি দিন গড়ালো না। হেলেনের বয়স তখন মাত্র ১৯ মাস। হঠাৎ এক গুরুতর রোগে পড়ে তার মস্তিষ্ক ও পাকস্থলির দারুণ ক্ষতি হলে হেলেন চিরদিনের মতো অন্ধ, বোবা ও কালা হয়ে যান। ফলে তিনি যা কিছু শিখেছিলেন সব ভুলে গেলেন। এমনকি কিভাবে মুখ দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করতে হয় সেটিও তার মন থেকে মুছে গেল।

মেয়ের এমন অবস্থা দেখে হেলেনের বাবা মা ভীষণ ভেঙে পড়লেন। একদিন সকালে পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে হেলেনের মায়ের চোখে একটি লেখা আটকে গেল। লেখাটি ছিল ইংল্যান্ডের উপন্যাসিক চালর্স ডিকেন্সের। শিরোনাম ‘আমেরিকান নোটস’। এই প্রবন্ধে তিনি বোস্টনের ডা. স্যামুয়েল গ্রিডলি হাউই কীভাবে একটি অন্ধ ও বধির নারীকে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন তারই আলোচনা করেছিলেন। প্রবন্ধটি পড়ে মিসেস কেট কেলার এক মুহূর্তও দেরি না করে ওই ডাক্তারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু হায়! ওই ডাক্তার ১০ বছর আগেই মারা গেছেন জেনে তিনি খুব নিরাশ হয়ে পড়লেন।

হেলেনের বয়স তখন ছয় বছর। কেলার দম্পতি খোঁজ করে বের করলেন ডা. আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলকে। ডা. বেল সব দেখে শুনে তাদের পরামর্শ নিতে বললেন, বোস্টনের ‘পার্কিন্স’ নামে অন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষয়িত্রীর সঙ্গে। ওই শিক্ষয়িত্রীর নাম অ্যানি ম্যান্সফিল্ড সুলিভ্যান। সুলিভ্যান সব শুনে বুঝে হেলেনের শিক্ষার ভার নিলেন হেলেনদের ‘আইভি গ্রিন’ নামক বাড়িতে।

সুলিভ্যান তার ছাত্রীর বগলে একটি পুতুল চেপে দিয়ে হাতের তালুতে ইংরেজি কয়েকটি অক্ষর লিখলেন এবং আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন। হেলেন প্রথমে বুঝতে না পারলেও কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝলেন যে, বগলের জিনিসটিকেই পুতুল বলা হয়। পানির পাম্পের তলায় হেলেনের হাত ধরে আগের মতোই হাতের তালুতে W-A-T-E-R লিখে সুলিভ্যান বুঝালেন যে, এটিকে বলা হয় WATER বা পানি। এভাবে এগিয়ে চললো হেলেনের শিক্ষা।

কেলার দম্পতির বাড়িতে সুলিভ্যানের কেটে গেছে দুই বছর। হেলেনের বয়স তখন আট। সুলিভ্যান ঠিক করলেন তাকে তাদের শিক্ষালয়ে অর্থাৎ ‘পার্কিন্স ইনস্টিটিউট’ এ নিয়ে যাবেন। কারণ সেখানে মূক বা বোবা ভাষায় কথা বলার জন্য হেলেন অনেক সঙ্গি পাবে। আর সব কিছু দ্রুত শিখে ফেলতে পারব। ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হেলেনের শেখার আগ্রহ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল।

১৮৯০ সাল। হেলেনের বয়স তখন ১০ বছর। এরই মধ্যে তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে ভালোভাবে লিখতে পড়তে এবং নদী, পাহাড়, গাছ, পাখি প্রভৃতি চিনে গেছেন। একদিন তিনি শুনতে পেলেন তারই মতো একজন বোবা কালা মেয়ে কথা বলতে আকার ইঙ্গিতে কথা বলতে শিখেছে। হেলেন জানতেন, দুনিয়ার সবাই তার বা তাদের মতো ভাবভঙ্গির ভাষায় কথা বলে না। তাই নিজের মূক ও বধিরতাকে জয় করার দুর্জয় সংকল্প করলেন তিনি। তার জেদে পড়ে মিস সুলিভ্যান শেষ পর্যন্ত তার ছাত্রীকে হোরেসম্যান বধির বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মিস সারাহ ফুলারের কাছে গিয়ে গেলেন। ফুলারের কাছেই তিনি বিভিন্ন ধরনের শব্দ উচ্চারণ করা শিখলেন।

হেলেনের বয়স যখন ১২ তখন তিনি অন্ধ বালক-বালিকাদের জন্য একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল খোলার চিন্তা করলেন এবং এ জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করলেন ২ হাজার ডলার বা পনেরো হাজার টাকা। এ সময়ই তার লেখা ‘ইউথস  কম্পোনিয়ান’ প্রবন্ধের বইটি প্রকাশিত হয়। এতো কম বয়সে হেলেনের এমন সব কার্যক্রম দেখে সবাই অভিভূত হয়ে গেলো। ১৮৯৬ সালে হেলেন ভর্তি হন কেমব্রিজ স্কুলে। এ স্কুলে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা বইপত্রের সংখ্যা খুব কম হলেও তিনি শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে খুব ভালোভাবে গ্রিক-ল্যাটিন, জার্মান এবং বীজগণিত ও জ্যামিতির পরীক্ষায় পাস করেন। পরে অর্থাৎ ১৯০০ সালে ভর্তি হন ৠাডক্লিফ কলেজে। এখানে চার বছরের কলেজ জীবনেই তিনি লিখেছিলেন তার ‘স্টোরি অফ মাই লাইফ’ ও ‘অপটিমিজ’ নামে দুটি বই।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে বিদেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। অন্ধ মূক ও বধির হয়েও একজন শিক্ষিত জ্ঞানী আত্মসচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে থাকে অভিনন্দন। টেক্সাস, অরিজোনা থেকে শুরু করে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, সুইডেন, ভারত, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও স্পেন থেকে হেলেনকে আমন্ত্রণ জানানো হলো তাদের দেশে যাওয়ার জন্য। অনেকে তার বইপত্র অনুবাদের অনুমতি চাইল। কেউ চাইলো বিষয় বিশেষে তার যুক্তি ও পরামর্শ। অন্ধরা চাইলো পথ নির্দেশ।

এ সমস্ত মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি একটি কথাই বলতেন যে ‘মানুষ বোবা-কালা অন্ধ হলেও সে যদি সব ক্ষেত্রে সবার সাহায্যে সহযোগিতা ও উৎসাহ পায় তবে সে হয়ে উঠতে পারে একজন শিক্ষিত আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মসচেতন মানুষ। ’ সারাজীবন প্রতিবন্ধী মানুষের সেবায় নিয়োজিত এই মানুষটি আলোর সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ১৯৪৬ সালের এক সকালে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৩ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।