হাসানাত ঘুম ভেঙে উঠে বসল। সর্বনাশ! পৌনে নটা বেজে গেছে!! আজ তো সাড়ে নটায় তার কোচিং।
কিন্তু মাম আর আব্বু? তারা কোথায়? তারা কেন ডাকেনি? সারা বাড়িতে কোথাও আব্বুকে খুঁজে পেল না হাসানাত। মানে আব্বু অফিসে চলে গেছে। আর মাম নাস্তা বানাচ্ছে। নাহ! এরা সবাই বাজে। শুধু ময়নাই ভালো।
কী সুন্দর “হাশানাত হাশানাত” বলে চেঁচিয়ে তাকে ডেকে তুলেছে। বারান্দায় গিয়ে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল হাসানাত। “তুই একটা লক্ষ্মী পাখি। আমার সোনার ময়না। ” বলল সে। তারপর দৌড়ে গেল রেডি হতে।
-কী ব্যাপার হাসানাত? এত তাড়াহুড়া কেন করছ? রান্নাঘর থেকে ডাকলেন মাম।
-মাম তোমরা এত খারাপ কেন? সাড়ে নটা বেজে আমার কোচিং না? আমাকে ডাকোনি কেন? বিরক্তি সহকারে উত্তর দিল হাসানাত।
-জেনে শুনেই ডাকিনি। তোমার এক ফ্রেন্ড ফোন করেছে। কোচিং নাকী হবে না আজকে।
হাসানাত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাম টেবিলে নাস্তা দিয়ে দিয়েছে। নাস্তাটা খেয়ে নিয়ে ময়নার খাবার নিয়ে বারান্দায় চলে এল ও। ময়নাটা কতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে! এখনো ওর নাস্তা করা হয়নি। ছাতুকে লাড্ডু বানিয়ে বাঁশের খাঁচার ফাঁক দিয়ে ময়নার মুখে তুলে দিল হাসানাত। ময়না খুব রাগ করে পেছন ফিরে রইল। খাবারের দিকে ফিরেও তাকালো না।
-কীরে? রাগ হয়েছে? আরে বাবা, আমি তো নাস্তা করছিলাম। আমি খেয়েই তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।
একদম দেরি করিনি। নে তো, পাগলামি করিস না। খেয়ে নে। বলল হাসানাত। ময়না কিন্তু মুখ ঘুরিয়েই রইল।
-আচ্ছা বাবা, মামকে বলব, তোমাকে বিরিয়ানি রেঁধে দেবে। হলো? এবার অন্তত খাও। হাসানাতের এই কথা শুনে ময়না ছোঁ মেরে ছাতুর লাড্ডুটা খেয়ে নিল। হালকা করে হাসল হাসানাত। বলল, “তুই আমার লক্ষ্মী ময়না। ”
এই ময়নাটাকে বাচ্চা অবস্থায় কিনেছে হাসানাত। ময়না পোষার খুব শখ ছিল তার। সেজো মামা অনেক খুঁজে এক জোড়া বাচ্চা ময়না জোগাড় করতে পেরেছে। একটাকে কিনে ফেলেছে। সেই থেকে এই ময়নাই হাসানাতের প্রাণ।
হাসানাতের কোনো বন্ধু নেই। নেই মানে ভালো বন্ধু, কাছের বন্ধু নেই। ও একা, কোনো ভাইবোন নেই। ক্লাসমেটরা সবাই কেমন স্বার্থপর ভাব। সেজন্য তাদের সাথেও খুব একটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। একা একা বন্ধু ছাড়া কী আর কেউ থাকতে পারে? তাই তো ময়নাকে পাওয়ার পর তাকেই বন্ধু ভাবতে শুরু করেছে হাসানাত। আগে সে অনেক পাখি পুষতো। লাভ বার্ড, টিয়া, ঘুঘু, কবুতর-সব। এখন শুধুই ময়না। অন্য পাখির যত্ন করলে ময়না যদি রাগ করে?
হাসানাতের মনে আছে, যখন প্রথম দিন সেজো মামা ময়নাকে খাঁচায় করে নিয়ে এল, সে কীভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিল। তারপর দৌড়ে গিয়েছিল খাঁচাটার কাছে। ময়না তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল। একটু ভয় পাচ্ছিল মনে হয়। প্রথমদিকে ও কিছু খেতেও চাইত না। মন খারাপ করে থাকত। পরে অবশ্য ঠিক হয়ে গেছে। এখন হাসানাতই ময়নার সবচেয়ে ভরসার জায়গা।
অনেক চেষ্টা করে ময়নাটা কথাও বলতে শিখেছে। হাসানাত শেখায়নি। ও নিজেই শুনে শুনে শিখেছে। হাসানাতকে ও “হাশানাত” বলে ডাকে। আর ক্ষুধা লাগলে বলে, “খেতে দাও, খেতে দাও। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি দাও। ”
শুধু তাই না, পাশের বাড়ির বুড়ো ময়নাটার সাথে ময়নার খুব ভাব হয়েছে। দুজন দুজনের সাথে সারাদিন গল্প করে। ময়না উঁচু স্বরে ডাকে, নিজের ভাষায় কিছু বলে বোধহয়। আর পাশের বাড়ির খাঁচা থেকে ওদের বুড়ো ময়নাটাও গলা উঁচিয়ে ডেকে উত্তর দেয়। কোনো কারণে যদি সে উত্তর না দেয়, ব্যস! তবেই হয়েছে। ময়নার রাগ আর কে দেখে! সে খাওয়া বন্ধ করে দেবে। চিৎকার করে ওই ময়নাকে বকতে থাকবে। সে এক হুলস্থূল ব্যাপার।
ময়নাকে গোসল করাতে হবে। সেজন্য পানি আনতে ময়নার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে এল হাসানাত। এই হয়েছে আরেক কাহিনী। ময়নাকে প্রতিদিন যত্ন করে ভালোভাবে গোসল করাতে হবে। আর সেটা হাসানাতকেই করাতে হবে। নাহলে ময়নার অভিমান হবে। শুধু ময়নার জন্যই হাসানাত কখনো কোনো পার্টি বা দাওয়াতেও যায় না। ঈদে সবাই গ্রামে যায়, মামা-খালা, কাজিনরা। সে যায় না। কী জানি বাবা! কাউকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।
ময়নাকে যদি ঠিকমতো যত্ন না করে? যদি বৃষ্টি আসে আর ওকে ঘরে ঢোকাতে ভুলে যায়? ঠাণ্ডা লেগে বেচারার বারোটা বেজে যাবে। গোসল না করালে? ময়না তো রাগ করবে। আচ্ছা, ওকে যদি ঠিক করে খেতে না দিতে পারে? কিংবা ও যদি কারো কাছে না খায়?
সর্বনাশ! ময়নাকে ফেলে কোথাও যাওয়াই যাবে না। ঠিক এই কারণগুলোতেই ময়নাকে রেখে হাসানাত কক্ষনো কোথাও যায় না। আর ময়নাটাও তাকে ভারী ভালোবাসে। একটু চোখের আড়াল হলেই চিৎকার ডাকতে থাকে, “হাশানাত, হাশানাত!”
ময়নাকে গোসল করিয়ে তার সাথে গল্প করে হাসানাত পত্রিকা খুলে বসল। ছুটির দিনে এটাই করে সে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ চোখে পড়ল- আজ বন্ধু দিবস!
কই! কেউ তো তাকে উইশ করল না! অবশ্য কে-ই বা করবে? তার কোনো বন্ধুই তো নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুকের ভেতর চাপা কষ্টকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করল হাসানাত।
আচ্ছা, আজকে কী সত্যিই কেউ তাকে সত্যি করবে না? সবার বন্ধু থাকে, তার কেন নেই? সে কেন কাউকে শুভেচ্ছা জানাতে পারবে না? আদরমাখা কণ্ঠে বলতে পারবে না, “বন্ধু তোকে ভালোবাসি। হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে। ”
হাসানাত অনেক ভাবতে চেষ্টা করল। কে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু? আসলেই কী কেউ আছে? থাকলে তাকে খুঁজ বের করা উচিত। আজকে তাকে বিশেষ কিছু দেওয়া উচিত। কিন্তু কে সেই বন্ধু?
মাম? মামকে হাসানাত ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু না। মামকে তার বেস্ট ফ্রেন্ড মনে হয় না।
আব্বু? আব্বুকে ছাড়া তো সে থাকতেই পারে না। সব কথা, সব আবদার আব্বুর কাছে। কিন্তু আব্বুও তার বেস্ট ফ্রেন্ড না।
তাহলে সেজো মামা? কিংবা ছোট মামা?
নাহ। তারাও না। তবে কে? অনেক ভাবে হাসানাত। এর মধ্যে ময়না তাকে না দেখে ডেকে ওঠে, “হাশানাত!” মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হাসানাতের। এই তো! সে বুঝতে পেরেছে কে তার বেস্ট ফ্রেন্ড।
ময়না!
হ্যাঁ। ময়নাই তার সেরা বন্ধু। কিন্তু ময়নাকে কী গিফট দেওয়া যায়? আবার ভাবনায় পড়ে সে। তারপর পেয়ে যায় কী আসলেই দেওয়া উচিত। ময়নার প্রতি একটা অন্যায় হচ্ছে। বিচার হচ্ছে। হাসানাত সেটা বুঝেও বোঝেনি।
দেখেও দেখেনি। শুধু দেখেছে তার আনন্দটুকু। তার সুখটুকু। ময়নার কথা একটিবারের জন্যও ভাবেনি। ছি! লজ্জা হয় হাসানাতের। কেমন বন্ধু সে? নিজের সুখের জন্য বন্ধুকে কষ্ট দিয়ে এসেছে দিনের পর দিন? নাহ। আর না।
আজই এই ভুল ভাঙতে হবে। এটাই হবে ময়নার জন্য হাসানাতের বন্ধু দিবসের উপহার।
মাম ময়নার জন্য বিরিয়ানি রেঁধেছে। নিজ হাতে সেটা ময়নাকে খাওয়াল হাসানাত। খাওয়ানো শেষে অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে বলল, “আমাকে তুই মাফ করে দিস ময়না। তোর প্রতি যে অন্যায় করেছি তার জন্য মাফ করে দিস। তুই আমার বন্ধু। আমার সেরা বন্ধু। তোকে আমি আর কষ্ট পেতে দেব না। আর না। ”
কাঁপা হাতে খাঁচার দরজা খুলে দিল হাসানাত। বের করে আনল ময়নাকে। দুহাতে চেপে বুকে আঁকড়ে ধরল। তারপর বারন্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে তাকে মুক্ত করে দিল। ময়না উড়ে উড়ে অনেকটা দূরে চলে গেল।
ভেজা দৃষ্টিতে উড়ন্ত ময়নার দিকে তাকিয়ে হাসানাত বলল, “যা ময়না, উড়ে যা। আর কষ্ট দেব না তোকে। তুই যেখানে খুশি চলে যা। এটাই তোর ফ্রেন্ডশিপ ডে গিফট। কী পছন্দ হয়েছে তো? শুধু একটা কথা। তুই ভালো থাকিস। অনেক অনেক ভালো থাকিস। হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে। ”
কিন্তু কল্পনাকে হার মানিয়ে ময়নাটা বারান্দার গ্রিল গলে মন খারাপ করা হাসানাতের পাশে চুপটি করে কখন এসে বসে আছে তা হাসানাত টেরই পায়নি। কিছুক্ষণ পর হাসানাত শুনতে পেল সেই চেনা ডাক “হাশানাত হাশানাত!”
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি
- [email protected]