ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

স্বপ্ন ওড়ানো লোকটা

আশিক মুস্তাফা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৪
স্বপ্ন ওড়ানো লোকটা

বড্ড সুখের মাস পৌষ। নির্মল নীল আকাশ।

ভালো লাগা ছড়িয়ে দিতে দিতে এখলাসপুরের ওপর দিয়ে ছুটে যায় পিনপিনে বাতাস। সেই বাতাসকে ভালোবেসে নিজ থেকেই দু’একটা পাতা ঝরিয়ে দেয় গ্রামের মাঝখানের পাগলা কদম গাছটা।

রাতের চেয়ে দিন ছোট হয়ে আসে। তাতে কী? এই ছোট্টমোট্ট দিনের ঝলমলে রোদ ভালোবাসা বিলিয়ে দেয় এইটুকুন তুতুনের নড়বড়ে শরীরে। তুতুনদের রোদ ঝলমল এই দিনগুলোকে নতুন করে রাঙাতে ভিন গ্রাম থেকে ছুটে আসে লোকটা।

তেমন কথা বলে না কারও সঙ্গে। আনমনে হাঁটে। নিচের দিকে চেয়ে। একাকী। একটু পর পর তাকায় আকাশে। ঢেউ খেলানো ধানক্ষেতের বাতাসে। কখনো কাছে ডাকে পিচ্চিদের। তার কাঁধে ঝোলে ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকে রঙিন কাগজ বের করে পুঁচকেদের বানিয়ে দেয় ঘুড়ি। লাগিয়ে দেয় ইয়াব্বড় একেকটা লেজ। যাকে ভালো লাগে লোকটার; তাকে কাঠিতে মোড়ানো সুতোও দিয়ে দেয়। তবে কারও কাছ থেকে টাকা নেয় না। চায়ও না। তার কাছ থেকে রঙিন ঘুড়ি পেয়ে পুঁচকেরা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেয়। ঘুড়ির বুকটা বাতাসের দিকে রেখে সুতো টেনে, আবার কখনো দৌড়ে তা উড়িয়ে দেয় শূন্যে।

এরপরের কাজটা বাতাসের। ঘুড়িটা খাড়া হয়ে থাকলেই হলো। গভীর সমুদ্রের বুক চিরে দক্ষ নাবিক যেমন জাহাজ নিয়ে যায় গন্তব্যে, তেমনি বাতাস ঘুড়িগুলোকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে স্থির করে দেয়। তবে মাঝেমধ্যে কিছু ঘুড়ির ওপরে ওঠার স্বাদ মিটে না! ওপর থেকে আরো ওপরে উঠতে চায়। মেঘ পুঁড়ে ছুঁতে চায় আকাশ।

ঘুড়ির হাত ধরাধরি করে তুতুনরাও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। ছুঁয়ে দেখতে চায় শাদা মেঘের পেঁজা শরীর। তাই চলন্ত গাড়ির চাকার মতো নাটাই ঘুরিয়ে ছেড়ে যায় সুতো। ছাড়তে ছাড়তে কারও নাটাই খালি হয়ে যায়। ছাড়া পায় ঘুড়ি। উড়ার গতি তখন আরো বেড়ে যায়। তুতুনরা ছুটে সুতোর পিছু। মাটি থেকে হাতের নাগালে সুতো। তারপর গাছের মাথা হয়ে হারিয়ে যায় শহৃন্যে। বাকাট্রা ঘুড়িও চলে যায় চোখের আড়ালে। মন খারাপ হয় ঘুড়ির মালিকের। মন খারাপ হয় তুতুনদের।

ভিন গ্রাম থেকে কেটে আসা ঘুড়ির পেছনেও হল্লা করে ছুটে পুঁচকেরা। কখনও পায়, কখনও ঘুড়ি গিয়ে আটকায় বাঁশঝাড়ের মাথায়। কখনও বড় শিমুল গাছটার ডালে।

তুতুনদের নয়ন পুকুর পাড়ের বিশাল সেই শিমুল গাছটা পৌষ মাস এলে ঘুড়িতে একাকার হয়ে যায়। রঙিন হয়ে উঠে ডাল। শুধু তুতুনদের গ্রামের নয়, ভিন গ্রামের ঘুড়িও উড়ে এসে ধরা পড়ে আকাশ ছোঁয়া সেই শিমুলের ছড়ানো-ছিটানো ডালে! শিমুলের ডালে রাতের শিশিরে নেতিয়ে পড়া ঘুড়ি দেখে পৌষের সকালগুলো কাটয় তুতুন! ডালের মাথায় ঝুলে থাকা ঘুড়ির নিষ্প্রাণ ওড়াউড়ি দেখে ঘুড়িদের জন্য কত যে মায়া লাগে তার!

নিজের অজান্তেই মন থেকে বেরিয়ে আসে সমবেদনা। বলে, ‘আহ বেচারা, কত কষ্টই না তাদের!’

ভিন গাঁয়ের লোকটা সেদিন তুতুনকে কাছে ডাকে। বানিয়ে দিতে চায় ঘুড়ি। তুতুন কেন যেন নিতে চায় না। শুধু কৌতুহল মিশ্রিত মনে তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। লোকটা তাকে কাছে টেনে নেয়। বলে, ‘এই খুকি, যাবি নাকি আকাশের দেশে?’

তুতুন কথা বলে না। তাকিয়েই থাকে লোকটার মুখে। কী ভেবে হঠাৎ বলে, ‘আকাশে কি পরী থাকে?’

লোকটা বলে, ‘হ্যাঁ থাকে। পরীরা অনেক গল্প জানে। তোকে গল্প বলবে। আদর করবে। তাদের রাজ্যে অভাব নেই কিছুর। বায়োস্কোপ আছে। আমতলি মেলা আছে। আরও কত কী সেখানে! যাবি?’
তুতুন এবার খুব আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘যাবো , এখনই যাবো। ’
লোকটা বলে, ‘বাহ, বড্ড সাহস তো তোর! জানিস, তোদের গাঁয়ের একটা মেয়েকে আজ পাঠিয়েছি আকাশে। দু’দিন থাকবে সেখানে। দল বেঁধে উড়বে মেঘের সঙ্গে। পরীরা তার সামনে নেচে নেচে গাইবে। মাথায় হাত রেখে গল্প শোনাবে। আরও কত কী করবে দু’দিন! শোন, দু’দিন পর ঘুড়িটা নামিয়ে আবার যখন উড়াবো আকাশে তখন ঘুড়ির ওপর বসিয়ে তোকে সেই মেয়েটার মতো পাঠিয়ে দেবো মেঘের দেশে। বুঝলি?’

একদিকে মাথা কাত করে তুতুন কিছুটা অস্পষ্ট করে বলে, ‘হুঁ। ’
অস্পষ্ট বলবে না কেন? দু’দিন তো অনেক সময়! আকাশে যাওয়ার জন্য তুতুনের ছোট্ট মনটা যে তখনই আঁকুপাঁকু শুরু করে দেয়। কিন্তু তুতুনের মনের কথা বুঝতে চায়নি লোকটা। তুতুন চেয়েছিলো মেঘের দেশে তখনই উড়ে যেতে। ঘুরে ঘুরে মেঘের গায়ে হাত রাখতে। পরীদের রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে। চুপটি করে বসতে মেঘবুড়ির কোলে!

মনটাকে স্বপ্ন দেখিয়ে আর ভিন গাঁয়ের লোকটার ঢাউস ঘুড়ির ভোঁ ভোঁ সুর শুনতে শুনতে সেদিন বাড়ি ফিরে তুতুন। বাড়িতে এসে সে কী ভাবনায় পড়ে গেলো! ঘড়ির কাটার মতো মনের ভেতর টিকটিক করে বাজতে থাকে, কেমন করে পরীদের সঙ্গে কথা বলবে। মেঘের নরম শরীরে কীভাবে তার পুঁচকে হাতটা ছোঁয়াবে। মেঘবুড়ির কোলে বসার বায়না ধরবে কেমন করে। এমন কত কী প্ল্যান খেলে যায় মাথায়!

রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে আকাশ। দেখে, সে একা বসে আছে একটা নরম মেঘের ওপর। কাছাকাছি আরো কয়েকটা মেঘ। সেই মেঘ তুতুনের দিকে চেয়ে চেয়ে শুধু হাসে। তুতুন বলে, অ্যাই হাসবে না কিন্তু! হাসলে আমি মেঘবুড়িকে বলে দেবো।

তুতুনের কথা শুনে মেঘদের হাসি আরো বেড়ে যায়। হো হো করে একটা আরেকটার গায়ে লুটিয়ে পড়ে। তখনই আসে দুইটা পরী। প্রজাপতির মতো ডানাওয়ালা গোলাপি পরীটা তার পিঠে তুতুনকে বসিয়ে সাঁই করে একটা উড়াল দেয়। বাপরে বাপ! কী গতি তার ডানায়! তুতুন তো আগে চড়েনি পরীর ডানায়। এই প্রথম চড়ে অবাক হয়ে যায়। ভাবে, কোত্থেকে পায় তারা এতো গতি! তার ছোট বুকটার ভেতর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। দূর থেকে আরেকটা পরী বুঝতে পরে বিষয়টা। সে তুতুনের ভয় কাটানোর জন্য উড়ে উড়ে নাচ দেখাতে শুরু করে। নাচতে নাচতে চলে আসে কাছে। পেছন থেকে হাতটা টেনে সামনে মেলে ধরে। একি, মুঠো ভর্তি চকোলেট! তুতুন হাত না বাড়িয়ে হা করে সব চকোলেট নিয়ে নেয় মুখে। পরীটা তা দেখে কী অদ্ভুত সুন্দর করে হাসতে থাকে! হাসতে হাসতে আরেকটা হাতও তুতুনের সামনে বাড়িয়ে দেয়। একি, আরো চকোলেট!

রাত শেষে ভোর হয়। সূর্য উঁকি দেয়। তবে শেষ হয় না তুতুনের স্বপ্ন দেখা। ভোরের আলো গায়ে মেখে মানুষ আস্তে আস্তে ব্যস্ততায় ডুব দেয়। কিন্তু তুতুন তখনো স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করে। সেদিন কোনো কাজেই মন বসাতে পারেনি। শুধুই ভাবনা আর ভাবনা। দিনমান ভবনার ভেতর ডুবে থাকে। খাবারের কথাও ভুলে যায়!

তাহিয়াদের মতো বড়লোক না তুতুনরা। দিনে আনে দিনে খায়-এমন পারিবার তাদের! তাই অনেক জামা-কাপড় নেই তুতুনের। সর্বসাকূল্যে জুতোও এক জোড়া। তাও পুরনো। ভেবেছিলো, বলে-কয়ে চাচাতো বোন তাহিয়ার কাছ থেকে নতুন জুতো চেয়ে নেবে। কিন্তু ঘটনার জানাজানি হবে ভেবে তার কাছে চাইলো না। পুরনো সেই জুতো আর মোটামুটি ভালো একটা জামা পরে, নিজের মতো সেজেগুজে চলে যায় পুকুর পাড়ে। যেখানে দাঁড়িয়ে ঢাউস ঘুড়ি উড়ায় ভিন গাঁয়ের লোকটা। যেখানে দাঁড়িয়ে সেদিন লোকটা তাকে আকাশে পাঠানোর কথা বলেছিলো, ঠিক সে জায়গাটায়।

সেখানে দাঁড়িয়ে ছোট চোখে ভয়কাতুরে ভাব নিয়ে আশপাশে তাকায়। দেখে, লোকটার ঢাউস ঘুড়ির মোটা গুণের দড়িটা কড়ই গাছের সঙ্গে বাঁধা। একটু হাটাহাটি করে কাছেপিঠে দেখলো। আনাগোনা নেই লোকটার। তাকে কী বলে ডাকবে তাও বুঝতে পারে না। একটু স্থির হয়ে দাঁড়াতেই কানে ভেসে আসে ঘুড়ির ভোঁ ভোঁ শব্দ। সেদিনের চেয়ে আজকের ভোঁ ভোঁটা জোরে হচ্ছে। অনেকটা বিমানের শব্দের মতো। তবু এই ভোঁ ভোঁ বড্ড ভালো লাগে তার।
কপালে হাত ঠেকিয়ে বড়োদের মতো করে এইটুকুন দুটো মায়াবী চোখে আকাশে খুঁজতে থাকে ভোঁ ভোঁ শব্দের উৎপত্তি রহস্য! দূরে, বহু দূরে আবিষ্কার করে কল্পলোকের বাহন। আহ, এই বাহনেই সে পাড়ি দেবে আকাশ। চড়বে পরীর ডানায়। পরীদের নাচ দেখতে দেখতে খাবে রাজ্যের চকোলেট।

কিন্তু লোকটাকে যে দেখা যাচ্ছে না। ছোট পায়ে পায়চারি করতে থাকে তুতুন। সময় কেটে যায়। দেখে, মাঠের ওপর থেকে রোদ তার ডানা গুটিয়ে নেয়। মাঠের গরু-ছাগলগুলো বাড়ির পথ ধরে। কাছের আকাশ থেকে স্বপ্নমাখা ছোট ছোট রঙিন ঘুড়িগুলো নামিয়ে বাড়ি ফিরে গাঁয়ের পুঁচকে-পাঁচকেরা। ডিমের কুসুমের মতো হয়ে আসা সূর্যটা টুপ করে ডুব দেয় ঝোপঝাড়ের আড়ালে। থেকে থেকে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে শুরু করে বাদুড়। সন্ধ্যের আলো-আঁধারিতে সেদিন হাতের আঙুলে বাদুড় গুনতে ইচ্ছে হলো না তুতুনের। শুধু ভাবে, লোকটার কথা। কেন আসছে না সে? কেন নামাচ্ছে না ঘুড়ির ওপর বসা মেয়েটাকে? তুতুনকে বসিয়ে ফের কেন ওড়াচ্ছে না ঘুড়ি? পাঠাচ্ছে না স্বপ্নের দেশে?

একসময় আলো-আঁধারির খেলা শেষ হয়। টিকে থাকে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে তুতুনের খোঁজ মিললেও খোঁজ মেলেনি ভিন গাঁয়ের সেই লোকটার। যেই লোকটা পৌষের শুরুর এই আলো-আঁধারিতে এসে তুতুনের স্বপ্ন উড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। সেই লোকটাকে আজও ভুলতে পারেনি তুতুন। হয়তো ভুলতে পারে না স্বপ্ন উড়ানো সেই আকাশি লোকটাও!

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।