আঁকাবাঁকা পথ আর ফসলি মাঠ পাড়ি দিতে দিতে সূর্য এখন ঠিক মাথার উপর।
নাতির মাথায় একটা তরমুজ তুলে দিয়ে ফুলজান বানু তার মেয়েবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন অনেকক্ষণ আগে।
ফুলজান বানুর কাঁখে একটা পোটলা। তাতে ঠাঁসাঠাঁসি করে সাজানো নানা পদের পিঠা, মুড়ি, ছাতু, সজনে, কাঁচা আম আরো কত কী! আর রতনের মাথায় একটা তরমুজ। হাঁসফাঁস গরমে তারা দু’জনেই ঘেমে-নেয়ে একাকার।
তেমাথা রাস্তার মোড়ে বিশাল বটগাছ। এই পর্যন্ত এসে তারা থামলো।
ফুলজান বানু রতনের মাথা থেকে ভারী তরমুজটা নামালেন। তখন রতনের ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। আপেলের মতো লাল হয়ে গেছে গাল দুটো। দাদি তাঁর আঁচল দিয়ে রতনের মুখ মুছে দিলেন। তারপর দু’জনে বটগাছতলা বসলেন। অদূরে দুটো কুকুর ঘুমাচ্ছিল। কুকুর দু’টো ঘুম জড়ানো চোখে তাদেরকে একবার দেখে নিলো এবং আগের মতোই ঘুমাতে লাগলো।
এ জায়গাটায় বেশ ঠান্ডা। দাদি ভাবলেন, অনেকক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া যাবে।
চন্দ্রনগর থেকে রঘুনাথপুর বেশ দূরের পথ। তা মাইল পাঁচেকের কম নয়। এদিকে যান-বাহনের বালাই নেই। হেঁটে চলাই একমাত্র ভরসা।
ফুলজান বানু শখ করে পালানে কয়েকটা তরমুজের বিচি বুনেছিলেন। ক’দিনেই তরমুজের চারা লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। তরমুজ গাছে পানি দেওয়া, নিড়ানো, মাটি আলগা করে দেওয়া, খড়ের বিছানা দেওয়া— এসব কাজে দাদিকে সবসময় সাহায্য করেছে রতন। সেই গাছে তরমুজ ধরেছিল দুটো। ক’দিন আগে তারা সবাই মিলে একটা খেয়েছে। বাকিটা নিয়ে যাচ্ছে উপহার হিসেবে। আগেরটা ছিল লাল টকটকে আর দারুণ মিষ্টি। দাদি-নাতির প্রত্যাশা— এটিও হবে আগেরটার মতো।
রতন বললো— ‘দাদি পানি খাব। ’
আশপাশে কোনো বাড়ি-ঘর নেই। পানি জোগাড় করা যাবে না।
তাই দাদি বললেন— ‘পানি পাবো কোথায় রে ভাই? বিন্নি মোয়া দেই একটা?’
রতন দাদির দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল। বললো—
‘মোয়া খেলে কি পিপাসা মিটবো?’
রতনের যুক্তিযুক্ত কথার পিঠে ফুলজান বানু আর কিছু বলার সাহস পেলেন না।
দাদি-নাতির কথা শুনে কুকুর দুটোর বোধ হয় ঘুমে ডিস্টার্ব হচ্ছিল। তাই বিরক্ত হয়ে চলে গেল।
ঠিক তখন মাঠাঅলার দেখা মিললো। বাহনে মাঠা নিয়ে সে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল তাদের পাশ দিয়েই। দাদি মাঠাঅলাকে ডেকে থামালেন এবং রতনকে ঠাণ্ডা মাঠা খাওয়ালেন। রতনের পিপাসা মিটলো।
তারা আবার হাঁটা দিলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর রতন বললো— ‘আর কতদূর দাদি?’
দাদি তর্জনী উঁচিয়ে দূরের গ্রাম দেখিয়ে বললেন— ‘ঐ যে দেখা যায় নারকোল গাছের সারি ভরা গিরামটা, ওখানেই তোর ফুপুর বাড়ি। ’
রতন লক্ষ্য করলো দূরের গ্রাম ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। শুধু তাই নয়, দোচালা টিনের ঘরটা, ক্ষেতের বেড়াটা, গাছটা, ডালটা— সবকিছু কেমন ঝিকমিক করছে। দেখে রতনের বেশ লাগলো!
সে ভাবতে লাগলো, কেন দোচালা টিনের ঘরটা, ক্ষেতের বেড়াটা, গাছটা, ডালটা ওরকম করে কাঁপছে?
হঠাৎ দাদি চিৎকার করে বলে উঠলেন— ‘ওরে রতন দ্যাখ, হাতি আসতেছে!’
ইয়া বড় হাতিটা! হাতির পেছনে এক পাল ছেলেমেয়ে। রঙিন জামা পরা মাহুত বসে আছে হাতির পিঠে। ছেলেমেয়েরা হাতিকে ঘিরে শোরগোল করছে। ভীষণ অবাক হলো রতন।
কিন্তু দাদি চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ, হাতির প্রিয় খাবার হচ্ছে তরমুজ।
হাতিটা রতনের খুব কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। ভয়ে রতনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। উৎসুক ছেলেমেয়েরাও হাতির কাণ্ড দেখার জন্য গোল হয়ে দাঁড়ালো। ফুলজান বানু রতনের কাছে যেতে চাইতেই হাতি তার লম্বা শুঁড় দিয়ে বাধা দিলো।
এবং রতনের তরমুজটা হাতি নিয়ে নিলো এবং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলা দেখাতে লাগলো।
মাহুত একগাল হেসে বলে উঠলো— ‘বাচ্চারা তালিয়া বাজাও। ’
সবাই হাততালি দিলো।
হাততালিতে যেন আরো বেশি উৎসাহ পেল হাতিটা। তরমুজকে ক্রিকেট বলের মতো কয়েকবার শূন্যে ছুড়ে দিলো এবং নিজের লম্বা শুঁড় দিয়ে সেটা ক্যাচ নিলো। একবারও মাটিতে পড়তে দিলো না।
হাতিঅলা আবার বললো— ‘তালিয়া হবে তালিয়া। ’
আবার হাততালির খই ফুটলো।
হাতির এসব কাণ্ড দেখে ফুলজান বানু ভীষণ বিরক্ত হলেন। ভীষণ রাগী কণ্ঠে মাহুতকে বললেন— ‘সার্কাস খেলা বন্ধ করো!’
মাহুত হাসতে হাসতে বললো— ‘আমার ক্ষেম্তা নাই দাদিজান। হাতিরে বলেন। ’
কিন্তু অবাক কাণ্ড ঘটালো হাতি। আস্ত তরমুজটা শূন্য থেকে মাটিতে ফেলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ঠাশ করে শব্দ হলো এবং সেটি ফেটে দু’খণ্ড হয়ে গেল। দুষ্টু ছেলেরা ভিড় ঠেলে তরমুজ নিতে চাইলেও হাতির শুঁড়ের বাধায় কেউ কাছে যেতে পারলো না।
হাতি একখণ্ড তরমুজ রতনের মাথায় তুলে দিলো বাকি খণ্ড সমান ভাগে ভাগ করে সবাইকে খাওয়ালো।
তারপর ছেলেমেয়ের বহর নিয়ে চলে গেল।
রতন অবাক হয়ে হাতির দিকে তাকিয়ে রইল।
দাদি বললো— ‘চল ভাই!’
ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৪