ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

পালের গোদা গগন দা | এহসান হায়দার

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৪
পালের গোদা গগন দা | এহসান হায়দার

গল্পটা আমাদের পাড়ার গগনদা’র। টিংটিঙে পাতলা আর লম্বা গগনদা’কে সবাই ভীতু গগন বলে ডাকে।

গগনদা তখন ক্লাস এইটে পড়েন, পরপর দু’বছর একই ক্লাসে পড়ছেন বলে তাকে নিয়ে অনেকে হাসাহাসিও করে।

আমরা কয়েকজন মিলে ধান কাটার মৌসুম এলেই বিলে গিয়ে দাওয়ালদের সঙ্গে রাতে আড্ডা মারি আর লোককথা, গল্প, গান এগুলো শুনতে শুনতে কেউ কেউ ওদের সাথেই ঘুমিয়ে যাই। পাড়ায় আমাদের প্রত্যেকের ভালো ছেলে বা গোপাল বালক নামে একটা সুনাম আছে। আমাদের দলে আমরা পাঁচজন- রনি, জাভেদ, জাহিদ ,গগনদা আর আমি। প্রায়ই আমরা উঠোন থেকে মাড়াই করা ধান নিয়ে যাই পালা করে জিলাপি খাবার জন্যে। এইটা হলো আমাদের পাণ্ডব দলের একমাত্র বলার মতো কাজ।

রোজকার মতো আমার পালা শেষে এলো গগনদা’র পালা। গগনদা’দের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব মোটামুটি দশ মিনিটের। ধান এনে আমরা দাওয়ালদের বিলের ঝুপড়িতেই রাখতাম। ভোরবেলা ময়রা পেটা সন্দেশ, ছানার জিলাপি, নারকেলের সন্দেশ, রসমালাই নিয়ে যেত রাস্তা দিয়ে। আমরা ক’জন রোজ সেই ধান দিয়ে কখনো সন্দেশ কখনো জিলাপি খেতাম। কখনোবা খেতাম রসমালাইও।

শীতকাল ছিল আমাদের জন্যে সব সময় মজার আর আনন্দের। স্কুলের পড়া নেই বার্ষিক পারীক্ষাও শেষ। কেবল মাঠে মাঠে ধান কাটার মৌসুম তখন। রাতে আবার কারো কারো বাড়িতে আগুন জ্বেলে ক্যাম্পফায়ারেরও আয়োজন হতো। তো গগনদা সেদিন তার বাবা গণি চাচার কাছে তাদের উঠোন থেকে ধান চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা খেলো। গগনদা’কে কানে ধরে দু’ধমক দিতেই আমাদের সবার নাম টপাটপ বলে দিলো।

পরদিন সকালে আমরা প্রত্যেকেই যার যার বাড়িতে বেদম প্রহারের শিকার হলাম। রনি বাড়িতে নজরবন্দি হয়ে থাকলো। মার খেয়ে জাভেদ গেলো খালার বাড়ি। জাহিদের এলো জ্বর আর বাবা আমাকে বললো- শহর থেকে এসেছো ক’দিনের জন্যে, পাড়ার সবাই কী ভাবছে বলতো? আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ফেলুদায় মুখ গুঁজলাম।

বেশ কিছুদিন চুপচাপ পড়ে থাকলাম আমরা; আর ওইদিকে গগনদা ঘুরতে লাগলো মহা আনন্দে। তাকে আর কে পায়। গণি চাচা তাকে কিছুই বলেনি। তার জন্যে ধমকই নাকি যথেষ্ঠ। সে প্রতিজ্ঞা করেছে আমাদের সাথে আর মিশবে না। আমরা দুষ্টু ছেলের দল। সপ্তাহ তিনেক এরই মধ্যে পার হয়েছে।
রনি, জাভেদ, জাহিদদের সাথে দেখা হয় নিয়মিত। আমাদের সবার এই ঘটনাও চাপা পড়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে আমারও বাড়ি ছেড়ে মিশনারিতে ফিরতে হবে। ধান কাটার মৌসুমও প্রায় শেষ হয়ে গেছে।

গতকাল বিকালে গাছি খেঁজুর গাছ কেটে গেছে। সকালে মা খেঁজুর রসের পায়েস রান্না করেছে। রনি ,জাভেদ, জাহিদসহ গগনদা ও পায়েস খাওয়ার দাওয়াতে হাজির। পায়েস খেয়ে সবাই পুকুর পাড়ে নারকেল গাছের তলায় আড্ডা মারছিলাম।

রনি হঠাৎ বলে উঠলো-হ্যাঁগো গগনদা তুমি যে আমাদের সেই মার খাওয়ালে তারপর আর আমাদের খোঁজও নিলে না?
গগনদা তখন মুখটা কাচুমাচু করে বললো-বাবা মানা করেছিল যে!
জাভেদ বললো- বাবা মানা করলো আর তুমি ভীতু মুরগির মতো তা দিতে শুরু করলে?
-না মানে, গগনদা ইতস্তত করতে শুরু করলো।
আমি বললাম- না মানে কী? তুমি তো একটা ভীতু, ভীতুর ডিম। সবাই একথা শুনে হেসে উঠলো।
আর গগনদা অমনি উঠে দাঁড়িয়ে বললো না,আমি ভীতু না।
আমরা আবার বললাম- না গগনদা তুমি ভীতু।

গগনদা বললো- আমি যে ভীতু না তার প্রমাণ চাস তোরা?
রনি বললো- হুম চাই, একশোবার চাই।
জাভেদ, জাহিদ এরাও সমস্বরে বলে উঠলো হুমমমমম চাই।
অগত্যা গগনদা বললো- কী করতে হবে বল?
আমি বললাম- আগামী বৃহ¯পতিবার গাছি আবার গাছ কাঁটবে। তুমি রহমান দাদুর বাড়ির গাছ থেকে এক ভাড় রস আনবে রাতে, কী পারবে?
গগনদা বললো-এ আর এমন কাজ কী, আমার কাছে তো নস্যি।
সিদ্ধান্ত হলো গগনদা রহমান দাদুর বাড়ি থেকে এক ভাড় রস আনতে পারলে আমরা তাকে আবার গগনদা বলে ডাকবো। আর আমাদের দলের নেতা হবে সে।

তারপর গগনদার সেই পরীক্ষার পালা চলে এলো। রহমান দাদুর এমনিতেই বয়স হয়ে গেছে রাতে ঘুমান না তেমন একটা। প্রায়ই ভোরের আজান শেষে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে এসে ঘুমান।

আর আমাদের ভীতুর ডিম গগনদাও সাহসের পরীক্ষা দিতে রাজি হয়েছে এ বাড়িতেই চুরি করে। রাত প্রায় শেষ। চারদিকে অন্ধকার অন্ধকার একটা ব্যাপার রয়েছে। রনি, জাভেদ, জাহিদ আর আমি তিন রাস্তার মোড়ে বসে পাহারা দিচ্ছি। গগনদা গেছে রস আনতে ।

রনি বলছে- উহ্ কতদিন চুরি করা রস খাইনে রে।
জাভেদ বলছে- পুরো ভাড় ধরে আমরা চারজন খাবো। তাহলে গগনদার সেদিনের মার খাওয়ানোর রাগটা মিটবে। এসব কথা যখন বলছি তখনই দেখলাম আমাদের পেছনের রাস্তা দিয়ে রহমান দাদুর বাড়ি থেকে কে যেন দৌড়ে আসছে। চেয়ে দেখি ফজলু কাকা। আমরা ওনাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম।

কী হয়েছে কাকা? চারজনেই একসঙ্গে জানতে চাইলাম।
ফজলু কাকা বললো- ডাক্তার ডাকো, গগন অজ্ঞান হয়ে গেছে।
আমরা অবাক হয়ে দ্রুত ডাক্তার আনতে গেলাম। ডাক্তার এসে দেখলো-গগনদা কেবলি বলে যাচ্ছে- ভূত ! ভূত! ভূত!
আমরা বুঝলাম গগনদা ভূত দেখেছে। কিন্তু ভূত বলে তো কিছু নেই।
পরে জানতে পারলাম গগনদার পরা লুঙ্গির কাছা খুলে নিজের পায়ে জড়িয়ে গিয়ে নিজেই পড়ে গেছে। আর তা ভূত বলে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। বিষয়টা পাড়ায় চাউর হয়ে গেলো। সেই থেকে ভূতে গগনকে আমরা ভীতু গগনদা বলি।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।