ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মায়মুনার দুঃখ | ‍আনিকা তাবাসসুম

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৬
মায়মুনার দুঃখ | ‍আনিকা তাবাসসুম

দুজন নারীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেলো মায়মুনার। চোখ মেলে তাকাতেই পলেস্তার খসে যাওয়া, লোহার শিক বের করা জরাজীর্ণ ছাদ চোখে পড়লো।

মায়মুনার বয়স সাত বছর। লম্বা চুল, খাঁড়া নাক আর টানা টানা চোখের সৌন্দর্যে ঢাকা পড়েছে তার শীর্ণকায় অপুষ্টিতে ভরা ছোট্ট দেহটি।

পাশের সেলে খুব চিৎকার আর হৈ চৈ হচ্ছে দুই নারী কয়েদির মধ্যে। কি একটি বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে বচসা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে এদের ধস্তাধস্তি, চুলোচুলিও হয়। খুবই নোংরা পরিবেশ। অনবরত খিস্তি-খেউর চলছেই। আসলে জেলখানার পরিবেশটাই এমন। নারী কয়েদিদের সঙ্গে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও থাকে। মায়মুনাও তাদের মতো একজন। তার মা এই কারাগারের একজন কয়েদি। সে ছোট, বিধায় তাকে তার মায়ের সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

জেলখানায় আসার আগে ওরা একটা বস্তিতে থাকতো। বস্তি হলেও সেটা জেলখানার চেয়ে অনেক পরিষ্কার ও খোলামেলা ছিল। সেখানে নিয়মিত ইউনিসেফের লোকজন আসতো। তারা মায়মুনাসহ বস্তির সব ছেলেমেয়েদের অনেক আদর করতো। চকলেট খেতে দিতো আবার লেখাপড়ার কথাও বলতো। খুব ভালো লাগতো মায়মুনার।

একদিন তারা তাদের বস্তিতে অনেকগুলো টিউবওয়েল বসিয়ে গেলো, আর বলে গেলো এখন থেকে পানি আনার জন্য তোমাদের আর ওই দূরের পাম্পে যেতে হবে না, কষ্ট করে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। এখানেই তোমরা মিলেমিশে ভালো পানি খেতে পারবে, আর ভালো পানি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকার। পাশের নদী থেকে পানি পান করা যাবে না। কেননা দূষিত পানি। অবশ্য এই নদী দূষণের জন্য আমরা মানুষরাই দায়ী।
ওদের সব কথা মায়মুনা বুঝতো না। তবে অপরিষ্কার পানি পান করলে যে অসুখ হবে এ কথাটা বুঝতে পারতো। ওরা আরও বলতো কোনো কিছু খাবার আগে তোমরা শিশুরা ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোবে। এ কথা বলে ওদের হাতে ছোট ছোট সাবানও দিতো।

এ রকম একটা সাবান এখনও মায়মুনার কাছে আছে। মাঝে মধ্যে সাবানটা হাতে নিয়ে দেখে আর আগেরকার সে সরল আনন্দের দিনের কথা মনে পড়ে ওর।

এখানে খাবার খেতেই বেশিরভাগ শিশুই তাদের হাত ধোয় না। জামায় হাত মুছেই খেতে বসে। হয়তো ওরা জানেই না যে খাবারের আগে হাত ধুতে হয়! তাইতো এখানে প্রায় সব শিশুই নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত। অবশ্য এখানে জেলখানার ডাক্তার রয়েছে। তাতে কি! আসলে এখানকার পরিবেশটাই সুস্থ নয়। শিশুদের জন্য তো মোটেই নয়। এখানকার খাবারগুলোও তেমন মানসম্মত নয়। ওর ওসব খাবার খেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মায়ের বকুনিতে বাধ্য হয়েই খেতে হয়। এখানকার শিশুরাও সব সময় কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। ফলে মায়মুনাও ওদের সঙ্গে তেমন খেলতেও যায় না।

ওদের বাড়ির পাশে ছিল একটি নদী। নদীটির নাম তুরাগ। নদীর দু’পাশে ছিলো সুন্দর শহর। বর্ষার সময় নদীর পানি বেশ পরিষ্কার টলটলে থাকতো। বাকি সময় নদীর দু’পাশের কল-কারখানার ময়লা এসে পানিটাকে খুব নোংরা করে ফেলতো। সেদিনটা ছিলো একটা পরিষ্কার ঝকঝকে দিন। আকাশে হালকা করে সুন্দর নরম রোদ দেখা যাচ্ছিল।

এইতো সে দিনের কথা! মায়মুনা ওদের উঠোনে ওর সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলছিল। বাবা গিয়েছে রিকশা চালাতে সেই ভোরে আজানের সময়। মা ঘরে একাই ছিলো। হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনে মায়মুনারা খেলা রেখে ফিরে তাকাতেই দেখে মা ধারালো রক্ত মাখা বটি নিয়ে পাশের বাড়ির মতি মিস্ত্রিকে অনবরত মারছে। এর কিছুক্ষণ পরেই মতি মারা যায়। আশপাশের লোকেরা বলাবলি করছিল মতি মিস্ত্রি নাকি মাকে কি খারাপ কাজের কথা বলেছিল।

মায়মুনা ছোট হওয়াতে ঠিক বুঝতে পারে না। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে মাকে ধরে নিয়ে যায়। আর মার সঙ্গে তাকেও থানায় থাকতে হয়। আর অবশেষে এই জেলখানা তাদের নতুন বাড়ি ঘর হয়।

‘মায়মুনা, মায়মুনা ওঠ, উঠে পড়। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খা। মায়ের কথায় ধ্যান ভেঙে যায় মায়মুনার। আস্তে আস্তে ওঠে বসে ও, ধীরে ধীরে কলপাড়ের দিকে যায়। এই বন্দি পরিবেশ ওর ভালো লাগে না। ও চায় মুক্ত পরিবেশ যেখানে বাবা থাকবে, মা থাকবে। থাকবে ওর আগেকার সঙ্গী-সাথীরা। সকাল হলে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সবার সঙ্গে দলবেঁধে স্কুলে যাবে, পাড়ালেখা করবে, খেলাধুলা করবে। নিজের অজান্তেই একফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে পড়ে মায়মুনার।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৬
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।