একদিনের পুতুল সংসারে কত মজাই না হতো! কাপড়ের ছোট টুকরো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শাড়ি পরানোর অভিনব সব কৌশল জানতো নাহিদা। এজন্য ওর আলাদা কদর ছিল পাড়ার ছেলেমেয়েদের কাছে।
শহরে তার কোনো ভালো বন্ধু নেই। সে একা ও বড্ড লাজুক প্রকৃতির। সবার সঙ্গে মিশতে জানে না। নতুন কারও সঙ্গে দেখা হলে কী করে কথা বলবে কিছু খুঁজে পায় না। জড়োসড়ো হয়ে আচমকা লজ্জাবতী গাছের পাতার মতো চুপসে যায়। বিষয়টা তার নিজের কাছেই খারাপ লাগে। অন্যের সঙ্গে মিশতে না পারাটা এক ধরনের চরম ব্যর্থতা। মিশুক মানুষকে শিল্পের সাঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আঁকাবুঁকি যেমন শিল্প, তেমনি অপরের সঙ্গে সহজে মিশতে পারাটাও এক ধরনের শিল্প। যুক্তিটা অতি দুর্বল। কেননা, সবার সঙ্গে খুব দ্রুত মেশায় লাভ ছাড়া যে ক্ষতি নেই সে নিশ্চয়তা খুব অল্প।
সঙ্গী নির্বাচন করতে হয় অতি সাবধানে এবং অতি সূক্ষ্মভাবে প্রবাদে আছে- সঙ্গী গুণে লোহা জলে ভাসে। একজন ভালো বন্ধু মানে জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। নাহিদার সে রকম কেউ নেই; যার সঙ্গে মনের কথা বলবে, পুতুলের বিয়ের ব্যবস্থা করবে। গ্রামের কিচ্ছা-কাহিনি আলোচনা করবে। তবুও সে যান্ত্রিক পুতুলের নাচ দেখে সময় কাটায়।
নাহিদা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। তবে বয়েস দশ পার হয়নি এখনো। কিন্তু কথা বলে বড়দের মতো। কথায় কথায় লজিক টানে এটুকু বয়সেই। গল্প পড়ার নেশা আছে তার। স্কুল পাঠাগার থেকে একটা করে বই আনে প্রতি সপ্তাহে। নাহিদা সায়েন্স ফিকশন পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেশি। এ জন্য কাল্পনিক ভাবনা তাকে অনেক নিয়ে যায় বহুদূর।
ছাদের উপর নাহিদার ছোট্ট একটা বাগান আছে। বাগানটা করেছে মাস দুয়েক হবে। এখনো সব ধরনের ফুল আনেনি নাহিদা। হাসনাহেনা ওর ভারি পছন্দ। তাই পুরো বাগানজুড়ে যেন হাসনাহেনার মেলা। একদিন বিকেল বেলা, নাহিদা ছাদে যায়। তাকিয়ে দেখে, হরেক রকম ফুল ফুটেছে বাগানে। ফুলের গন্ধে সারা বাগান ম-ম করছে। দেখল পাপড়িতে একটা রঙিন প্রজাপতি বসে আছে, আরেকটা উড়ছে। দেখতে দুইটা হুবহু এক রকম। নাহিদা ধরতে যায়। হাতে ছুঁয়েও ধরতে পারে না। অনেক ব্যর্থতার পর এক সময় ঠিকই ধরে ফেলে সে। কিন্তু কাণ্ড ঘটলো অন্য জায়গায়। প্রজাপতিটাকে ধরার সঙ্গে সেটা এক সুন্দর পরীর মতো রূপ ধারণ করলো।
প্রথমে নাহিদা ভয় পেয়ে যায়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গল্পের বইয়ে দৈত্য ও পরীর অনেক কাহিনি পড়েছে সে। বুকে সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করে- তুমি কে? আমার বাগানে কেন এসেছ? দৈত্যটি নরম গলায় জানায়, আমি বাটারফ্লাই গ্রহের পরি। আমার নাম ফ্র্যাঙ্ক। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। হবে আমার বন্ধু? নাহিদা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। মনে মনে ভাবে, বাটারফ্লাই নামে কি কোনো গ্রহ আছে? তবে এ নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামালো না। পুতুল খেলা তোমার খুব পছন্দ, না? মুখে ঈষৎ হাসি নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক বললো। তুমি জানলে কী করে? নাহিদা কৌতূহল নিয়ে জানতে চায়। ফ্র্যাঙ্ক বলে- আমি সব জানি। চিপ্স খেতে ভালোবাসো, রাইট? নাহিদা আশ্চর্য হয়ে মাথা নাড়ে। ব্যাগ থেকে ফ্র্যাঙ্ক একটা পটেটো ক্র্যাকার্স বের দিলো নাহিদার হাতে।
নাহিদা তার কোলের পুতুলটা মেঝের উপর রাখলো। দেখাদেখি ফ্র্যাঙ্কও ব্যাগ থেকে অন্য একটা পুতুল বের করে রাখলো পাশে। তুমি শাড়ি পরাতে জানো? প্রশ্ন করলো ফ্র্যাঙ্ক। নাহিদা পুতুল হাতে নিতে নিতে উত্তর দেয়- হ্যাঁ, পারি। দেখাবো? দেখি তো! ফ্র্যাঙ্কের কৌতূহলী জবাব। নাহিদা এতো সুন্দর করে শাড়ি পরালো যে ফ্র্যাঙ্ক খুশিতে নাচতে শুরু করে দিলো। এই, এই, থামো! থামো! মা বকবে। তুমি তো দেখি ভালো নাচতে জানো। ফ্র্যাঙ্ক বসতে বসতে বললো, মোটামুটি জানি। এখন বলো তুমি কী চাও? যাওয়ার আগে আমি তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করে দেবো। আমার তেমন কোনো ইচ্ছে নেই। তবে একটা আছে। আমি পুতুলের বিয়ে দেখতে চাই।
তারপর ফ্র্যাঙ্ক এবং নাহিদার পুতুল খেলা চলতে থাকে। পুতুলের বিয়ে ভাঙে নাহিদার মায়ের ডাকে। অনেক সময় ধরে ওকে না দেখে মা খুঁজতে বেরোয়। মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে জামার পেছন ঝাড়তে ঝাড়তে নাহিদা উঠে দাঁড়ায়। ফ্র্যাঙ্ককে টা-টা দিতে দিতে নিচে নামতে থাকে। ফ্র্যাঙ্কের মনটা খারাপ হয়ে যায় নাহিদা চলে যাচ্ছে দেখে। আড়াল হওয়ার আগে গলা বাড়িয়ে নাহিদা বলে ওঠে- কাল আবার এসো ফ্র্যাঙ্ক। দেখা হবে...
বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৭
এএ