ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ফচুর মায়া | বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৮
ফচুর মায়া | বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী প্রতীকী ছবি

ফচুর মা রাস্তায় কাজ করে। এলজিইডি’র রাস্তা সংস্কারের কাজ। দু’একদিন কাজ থাকে না। তখন পানিফল তুলতে যায়। ফচুও সে সময় মায়ের সাথে যায়। মা ভিটের নিচে জলাশয়ে পানিফল তোলে। আর বেড়ের ওপর একটি কাঁঠাল গাছের তলায় বসে খেলা করে ফচু।

কাঁঠালগাছের মগডালে পাখির বাসা। ডাল-পাতার মধ্যদিয়ে তার খড়কুটো দেখা যায়।

সেখানে গলা উঁচু করে দুটো বাচ্চা ভীষণ ‘ক্যা ক্যা’ করছে। তাদের চামড়ায় এখনো পশম ধরেনি। মা পাখিটা আরো জোরে চেঁচাচ্ছে। যাচ্ছে এ ডাল থেকে ও ডালে। ওদের ডাকাডাকিতে আরো কয়েকটি পাখি এসে যোগ দিয়েছে। ফচু ভাবলো, বাচ্চগুলোর খাবার জোগাড় করতে পারেনি মা পাখি। ওদের পানিফল খাওয়াতে হবে।

ফচু চেঁচিয়ে মাকে বলে,  মা, একটা পানিফল ছুড়ে দাও!
-কেন?
-খাবো।

মা একটি পানিফল ছুড়ে দিয়ে বলে, দেখিস― কাঁটা!, ধুলো মুছে নিস!

ফচু কলার পাতায় ধুলো মুছে নেয়। সাবধানে কাঁটার ফাঁকে দাঁত বসিয়ে শাস বের করে। মুখের মধ্যে কিছুটা চলে গেলে খেয়েও ফেলে। ফচুর প্যান্টের পকেট ছেঁড়া। তাই অর্ধেক শাস হাতে করে নেয়।  

ফচু সাবধানে গাছে ওঠে। আঙুলের কারসাজিতে পানিফলের শাস ধরে রাখে। ওই হাতেই একটি ডাল ধরে। হাতের শক্তিতে ছোট্ট শরীরটিকে তুলে নেয় ডালের পরে। এভাবে ডাল বেয়ে বেয়ে অর্ধেক উঠে যায়। পাখিগুলোর ডাকাডাকি আরো বেড়ে যায়।  

ফচু ওপরের দিকে তাকিয়ে বাসার নিশান দেখে নেয়। আর দেখেই চোখ চড়ক গাছ! বাসার পাশেই ঘন পাতার মধ্যে মুখ বের করে আছে একটা সাপ! তামার তারের মতো লকলকে জিভ! একবার মুখের ভেতর ঢোকাচ্ছে, আর একবার বের করছে!

মা মুখ উঁচু করে দেখে। কাঁঠালতলা ফাঁকা! ফচু কই! ছ্যাক করে ওঠে মায়ের মন। মা ডাক দেয়, ‘ফচু!, ও ফচু! কোথায় গেলি!’ ফচু সাপের ভয়ে জমে থাকে। মায়ের ডাকে সাড়া দেয় না। মায়ের চোখ ফচুকে খুঁজে পায়। ফচু কাঁঠালগাছে সেঁটে আছে। মা কাজ ফেলে তাড়াতাড়ি উঠে আসে। কী সাংঘাতিক! গাছে কেন তুই! নেমে আয়, আগে নেমে আয়!

ফচু ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে নেমে আসে। মা টানতে টানতে বাড়ির পথে হাঁটে। পাখিগুলো আরো জোরে ডেকে ওঠে। ফচু পেছন ফিরে তাকায়। ভাবে, ‘মা পাখিটা ফচুকে বলছে, সাপের হাত থেকে আমার বাচ্চাগুলোকে  বাঁচাও!’  


ফচু মাকে বলে, মা, সাপে পাখির বাচ্চা খাচ্ছে! মা থমকে দাঁড়ায়। কী! ওই গাছে সাপ ছিল! ফচু মাথা নেড়ে বলে,  হুঁ।
-সেকি! ভয় পাসনি তো!
-না।
মা ফচুকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। চল, শিগগিরই বাড়ি চল, আর কোনোদিন এখানে আনবো না তোকে।
ফচু ঘরে ঢোকার আগে মাকে বলে, রাসেল ভাইদের বাড়ি থেকে বইগুলো আনব মা?
-যা, তাড়াতাড়ি আসিস। পানিফলের ঝুড়িটা বারান্দায় রাখতে রাখতে বলে মা।

ফচু এক’পা দু’পা করে বাড়ি থেকে বের হয়। মায়ের আড়াল হলেই জোরে ছুট দেয়। একছুটে একেবারে মান্দার ওঝার বাড়ি।

মান্দার ওঝা বারান্দায় বসে হামান-দিস্তায় কী সব বানাচ্ছে। ফচু হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, শিগগির চলেন!
-কোথায় ?
-ও-ই পানিফলের বেড়ে।
-কাউকে সাপে কেটেছে?
-হুঁ।
-কাকে?
ফচু একটু চুপ থেকে বললো, আমার বন্ধুকে।
-সাপ দেখতে পেয়েছিস?
-হুঁ, কালো-বড়! 
মান্দার ওঝা তাড়াতাড়ি এটা-ওটা থলেতে পুরতে পুরতে বলে, হুঁ, বুঝতে পেরেছি। তারপর থলেটা একটানে পিঠের পরে তুলে বলে, চল। চলতে চলতে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে, টাকা দেবে কে?
-আমার মা।  
-তোর মা! তোর মা কী করে?
-আমার মা রাস্তায় কেয়ারের কাজ করে।
-ও চল! তাড়াতাড়ি চল!

মান্দার ওঝা বেড়ের ওপর এসে একটা ঢেঁকুর তুলে জিজ্ঞেস করে, কই! তোর বন্ধু কোথায়? কোনো লোকজন তো দেখছি না।

তখনও ওই কাঁঠালগাছে পাখির ডাকাডাকি চলছে। ফচু সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই গাছের মাথায়।

মান্দার ওঝা ঢেঁকির মতো মাথাটা বার দুয়েক ওপর নিচু করে বললো, তোর বন্ধু গাছের মাথায়! সাপে কাটা বন্ধু গাছের মাথায়!
-হুঁ, তাড়াতাড়ি গাছে উঠুন, ওখানে একটা সাপ আছে, পাখির বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলছে।

সাপে পাখি খাচ্ছে। আর সে কারণে ওঝা ডাকা। ক্ষেপে বোমা হয়ে গেলো মান্দার ওঝা। বললো, পাজি, ছুঁচো, বিটকেল, ইয়ার্কি পেয়েছ? ভাবছো আমি যদুমদু!

ফচু ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু দমে গেলো না। বলল, আপনার তো টাকা হলেই হলো।
-দে, আগে টাকা দে! তারপর কাজ।

ফচু একটু সাহস পেলো। বললো,  টাকার বদলে আমি দু’কেজি পানিফল দেবো, আপনি দয়া করুন।
ছ্যাক করে রাগ বেড়ে গেলো মান্দার ওঝার। বললো, বেয়াদপ! মশকরা পেয়েছ না! ও জিনিস আমি ফ্রি দিলেও নিই না। ’ বলেই গজগজ করতে করতে চলে গেলো।  

নিরূপায় ফচু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। ওঝার পিঠে থলেটি নাচতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে থাকে ফচু। ছোখ দুটো জলে ভরে যায়।

সুখের কথা― ওঝার চেঁচামেচিতে হোক, আর ওঝাকে দেখে হোক, সাপটি চলে গিয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।