বর্ষার বাবা একজন প্রখ্যাত প্রকৌশলী। শহরের বিভিন্ন বিখ্যাত দালান তথা অট্টালিকার নকশা এঁকেছেন তিনি।
বর্ষা তার বাবাকে বলেছে যে, সে বইয়ে পড়েছে এদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার লোক উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম। মেয়ের এমন গাম্ভীর্যপূর্ণ অথচ বাস্তব-তথ্য সমৃদ্ধ কথা শুনে কিছু বলতে পারেন না বর্ষার বাবা। শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রতি এই বলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন যে, এই রকম মননশীল চিন্তা-চেতনার অধিকারী যদি সব শিশু হতো তাহলে এই দুঃখিনী বাংলার বুকে কোনো দুঃখ জমাট বাধা থাকতো না।
শহরের অভিজাত এলাকার বৃহৎ প্রাসাদোপম বাড়ি বর্ষাদের। বাড়ির সীমানা বেশ উঁচু। ওসব দেয়ালের উপরিভাগে উল্টো করে পেরেক গাঁথা রয়েছে। কারণ কিছুই নয়, চোর-ডাকাত বা অন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের দেয়াল টপকাতে যেন সুবিধা না হয় সেজন্য। বাড়ির চারপাশে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গাছের সারি। বাড়ির বারান্দায় গ্রিলে হাত রেখে বর্ষা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তার দৃষ্টিসীমানা পর্যন্ত। সে প্রায়ই দাঁড়ায় বারান্দায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবলোকন করে তাদের বাড়ির পাশে থাকা বস্তির লোকদের জীবনধারা। শহরের অভিজাত এলাকা হলেও বস্তিবাসীরা অনেক আগে থেকে এখানে আশ্রয় গেঁড়েছে। ওদের প্রায় প্রতিদিন দেখতে দেখতে বেশ কয়েকজনের মুখ বর্ষার কাছে অতিচেনা হয়ে গেছে। সেই চেনাদের মধ্যে প্রায় দশ বছর বয়সী এক মেয়েকে তার বড় আপন মনে হয়। সে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। জানতে চায় তার আনন্দ বেদনার কথা। এভাবেই একদিন অই মেয়েটির সঙ্গে কথোপকথন হয় বর্ষার। মেয়েটির নাম ঝুমা, অতঃপর ঝুমা হয়ে যায় বর্ষার বন্ধু।
বর্ষা মৌসুম শুরুর প্রথম থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের কারণে সারা দেশজুড়ে বন্যা। বর্ষা টিভির নিউজ দেখে, বেতার শোনে, পত্রিকা পড়ে বন্যা সম্পর্কে জানার জন্য। তার মনে দুঃখ এসে ভর করে বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য। সে তার কাছে জমানো টাকা-পয়সা, তার পুরনো কাপড় ত্রাণকর্মীদের কাছে দান করে। মনে মনে ভাবে, তার দেওয়া সাহায্যে যদি একজন দুর্গতও উপকৃত হয় তাহলে ওটাই হবে তার বিরাট সাফল্য। বর্ষা ও তার কয়েকজন সহপাঠী মিলে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে ত্রাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরে। অতঃপর সংগৃহীত ত্রাণ দুর্গতদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়।
একদিন রাতে প্রচণ্ড হৈ-হুল্লোড় শোনা যায় বর্ষাদের কাছের বস্তিতে। চিৎকার, আহাজারিতে ঘুম ভেঙে যায় সবার। বাড়ির বাইরে বের হলে তারা দেখতে পায় বস্তিটা প্রায় তিন হাত পানির নিচে ডুবন্ত। অসহায় মানুষেরা যে যেদিকে পারছে ছুটছে। কেউবা ঘরের চালে উঠে বসে রয়েছে, কেউ শেষ সম্বল বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কেউ প্রিয়জনদের প্রাণ রক্ষায় তৎপর। এই দৃশ্য দেখে বর্ষারবুক হু হু উঠলো।
ঘটনার পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে বর্ষা দেখলো প্রতিদিনকার পরিচিত এলাকাটিকে মনে হচ্ছে যেন কোনো অপরিচিত নতুন জায়গা। কোলাহল মুখর বস্তিটায় যেন ভূত সবার গলা চেপে ধরেছে। নীরব লাগছে চারদিক। কখনও বা ক্ষুধার্ত শিশু মায়ের কাছে খাবার চেয়ে কেঁদে ওঠে।
বর্ষার মনে উঁকি মারে ঝুমার কথা। সেই সুন্দর-সুশ্রী কোমল মুখখানার কথা। ঝুমা বস্তির গণশিক্ষা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। বানান করে করে সুরেলা সুরে কবিতা পড়তো। ছন্দে ছন্দে নামতা গুনতো। ওর মা বাবা কেউ ছিল না। বস্তিতে এক দূর সম্পর্কের মামার বাড়িত থাকতো সে। লেখাপড়ার প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক দেখে বর্ষা তাকে খাতা, কলম, বই কিনে দিয়েছিল। প্রতিদিন বিকেলবেলা এসে বর্ষার কাছে এসে পড়তো ঝুমা।
বর্ষা, বাসার কেয়ারটেকার জামালকে বস্তিতে পাঠালো ঝুমাকে নিয়ে আসার জন্য। আগের দিন রাতে ঢলের পানি আসার আগে-পরে ঝুমা কেমন ও কী অবস্থায় ছিল তা জানার জন্যে।
বর্ষা সকালের নাস্তা করলো না। পড়ার ঘরে বইপত্র অগোছালো পড়ে থাকলো। কারও সঙ্গে কথা বলছে না সে। চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। কারো কোনো প্রশ্নের জবাবও দিচ্ছে না। তার বাবা অফিস থেকে ফিরলে কোনো কথা বলে না সে। হঠাৎ ভোঁ করে কেঁদে ওঠে এবং কাঁপা কাঁপা গলায় বলে– বাবা, ঝুমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ও গতকালকে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। মেয়ের কথা শুনে কোনো কথা বললেন না বর্ষার বাবা। মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন।
বহু খোঁজাখুঁজি করে ঝুমার মরদেহ পাওয়া গেলো। পারিবারিকভাবে ঝুমার দাফন হলো। সবকিছুই করলেন বর্ষার বাবা। ঝুমার কবরের উপর বেশ কয়েকটি ফুলের গাছ লাগিয়েছিল বর্ষা। প্রতিদিনই গাছগুলির গুঁড়িতে পানি ঢালে সে। কদিন যেতেই ফুলে ফুলে ভরে উঠলো গাছগুলো, যেন ঝুমার মায়াবি হাসি। বর্ষা ফুলগুলো বড্ড ভালোবাসে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০১ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০১৯
এএ