ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ছোটদের শামসুর রাহমান

আবু আফজাল সালেহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২০
ছোটদের শামসুর রাহমান

আধুনিক বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) উজ্জ্বল এক নাম। বাংলা সাহিত্যের অন্য বড় কবির মতো তিনিও ছোটদের জন্য অনেক ছড়া লিখেছেন।

যদিও তার ছড়া সাহিত্য খুব কম আলোচিত। সমাজের কাছেপিঠের উপাদান, রূপকথা, মিথ, ইতিহাস ইত্যাদি তার ছড়া-কবিতার উপাদান।

শামসুর রাহমানের প্রকাশিত ছড়াগ্রন্থ ১৪টি। গ্রন্থগুলোর নামাকরণেও রয়েছে নান্দনিকতা। কোনোটায় মনে হয় সামনে শিশুর মুখ ভেসে উঠছে। শিশুদের প্রিয় জিনিসগুলো নিয়ে তার ছড়াগুলো দারুণ। ছড়াগ্রন্থগুলো হলো: ১. এলাটিং বেলাটিং, ২. ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো, ৩. গোলাপ ফোটে খুকির হাতে, ৪. রঙধনুর সাঁকো, ৫. লাল ফুলকির ছড়া, ৬. আগুনের ফুলকি ছোটে, ৭. নয়নার জন্যে, ৮.ইচ্ছে হলো যাই ছুটে যাই, ৯. তারার দোলনায় দীপিতা, ১০. সবার চোখে স্বপ্ন, ১১. চাঁদ জেগেছে সবার চোখে, ১২. আমের কুঁড়ি জামের কুঁড়ি ১৩. হীরার পাখির গান ও ১৪. গোছানো বাগান।  

১৯৯৮ সালে কবির ৭০তম জন্মদিনে প্রকাশিত হয় কবির ছড়াসমগগ্র। বইটিতে কবির প্রথম ৬টি ছড়ার বইয়ের সবগুলো ছড়া তো আছেই, আরও আছে তখনও বইয়ের বাইরে থাকা আরও ৪০টি ছড়া। সেগুলো পরে তার অন্য ছড়ার বইয়ে জায়গা পেয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থের অধিকাংশ ছড়ার মধ্যেই ফুটে উঠেছে শিশুর প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দরদ। তার ছড়ায় আছে ছোটদের মনভোলানোর রূপকথার কাহিনী, আছে স্বপ্নরাজ্যের হাতছানি।  


কবি প্রথমেই বলেছেন তিনি কাদের জন্য ছড়া লেখেন। কবি তার দুই নাতনি নয়না ও দীপিতাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য অনেক ছড়া লিখেছেন। পরবর্তীসময়ে এগুলো ক্লাসিক মর্যাদা পেয়ে গেছে। এলাটিং বেলাটিং এ কবি লেখেন-  
‘যারা বেড়ায় উড়ে পক্ষিরাজের পিঠে,
যারা জিরোয় বসে স্বপ্নবাড়ির ভিটে,
যারা ভেলকি বোঝে হঠাৎ মিলের ফাঁদের,
ফাঁদের ফাঁদের ফাঁদের।
আমার ছড়ার এ বই পড়তে দেবে তাদের
তাদের তাদের তাদের। ’
(এলাটিং বেলাটিং/সংক্ষেপিত)

কবি তার ছড়ায় কেবল ছন্দের দোলাই দেননি, কল্পনার ছবি এঁকেছেন। ছড়াগুলো অনেকসময় কিশোর কবিতা হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, এলাটিং বেলাটিং- এর প্রায় প্রতিটি ছড়ায় তিনি সচেতনভাবে গ্রামীণ জীবনের উপকরণ ব্যবহার করেন। একটি উদাহরণ- 
নীলের ঘোড়া নীলের ঘোড়া পক্ষিরাজের ছা, 
মেঘডুমাডুম আকাশপারে তা থৈ তা থৈ তা।
মেঘের দোলায় চললি কোথায়, কোন সে অচিন গাঁ
আয়-না নেমে গলির মোড়ে করবে না কেউ রা। ’
(আমায় নিয়ে যা, এলাটিং বেলাটিং)

জল-টুপটুপ, খোকন গেছে ক্ষীরসাগরে, জটিবুড়ির ছড়া, চরকাবুড়ি, আঁটুল-বাঁটুল ছড়া, খুকুমণির বিয়ে- এই ছড়াগুলোর নাম থেকেই বোঝা যায় যে, আমাদের রূপকথার চরিত্র ও কাহিনি নিয়েই তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন এই ছড়াগুলো। যেমন-
‘আঁটুল বাঁটুল শামলা সাঁটুল শামলা গেছে হাটে
কুঁচবরণ কন্যে যিনি, তিনি ঘুমান খাটে।
খাট নিয়েছে বোয়াল মাছে, কন্যে বসে কাঁদে,
ঘটি-বাটি সব নিয়েছে কিসে তবে রাঁধে?
আর কেঁদো না আর কেঁদো না ছোলাভাজা খেয়ো,
মাটির উপর মাদুর পেতে ঘুমের বাড়ি যেয়ো। ’ 
(আঁটুল বাঁটুল ছড়া) 
 
‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার কথা কে না জানে! এটি রীতিমতো প্রবাদের মতো হয়ে গেছে প্রায় প্রতিটি চরণ। চিলে কান নিয়েছে শুনে সবাই চিলের পিছে ছুটছে, অথচ কেউ খেয়ালও করছে না, কান আদৌ চুরি হয়েছে কিনা! অসাধারণ ছড়াটি-
‘এই নিয়েছে ঔ নিল যা
কান নিয়েছে চিলে।
চিলের পিছে ঘুরছি মরে
আমরা সবাই মিলে। ’
(পণ্ডশ্রম, ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো) 

ঝড়ের বিবরণ শেষে ঝড় শেষের মানুষের অসহায়ত্বের বিবরণ তুলে ধরেছেন একেবারেই সাদামাটা ভাষায়। কিন্তু সেই সাদামাটার ভাষার বর্ণনাই কী অসম্ভব শক্তিশালী! কী অসাধারণ!
‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে 
খেঁকশেয়ালের বে।
সর্বনাশা ঝড়ের পরে 
কোমর বাঁধে কে?’
(সাইক্লোন, ধান ভানলে কুঁড়ো দেব)

ছড়ার মাধ্যমে কবি সমসাময়িককে তুলে ধরেছেন। সময়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। নানা অনিয়ম অপ্রাসঙ্গিতা তুলে ধরেছেন। এরকই একটি বিখ্যাত ছড়ার নাম-- ‘যা রাজাকার’।  
‘যা রাজাকার ভেগে যা,
এদেশ ছেড়ে ভেগে যা
খোকার সাহস দেখে যা, 
মারের মজা চেখে যা।
তোদের হাতে খুনের দাগ
ভাগ রে তোরা জোরসে ভাগ। ’
(যা রাজাকার, রংধনুর সাঁকো)

রূপক ছড়া লিখলেন বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ’ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ ছড়াটিতে তিনি লিখলেন—
‘ছেলে ঘুমায় না, পাড়ায় জুড়ায় না
বর্গিরা এল দেশে।
বর্গি তাড়াবে তাই তো খোকন
সাজল বীরের বেশে। ’

‘রূপকথা’ নামের ছড়াটিও এক সময় খুব বিখ্যাত হয়েছিল। এটি একটি রূপক ছড়া। সোজা করে বললে একটা জিনিসকে অন্য কোনো জিনিসের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করাই রূপক। তার এই ‘রূপকথা’ নামের ছড়ার ‘আজব দেশের ধন্য রাজা’ বলে তিনি তখনকার স্বৈরাচারী শাসক এরশাদকে বুঝিয়েছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় এই ছড়াটি রীতিমতো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছড়াটি এমন-
‘আজব দেশের ধন্য রাজা
দেশজোড়া তার নাম
বসলে বলেন, ‘হাঁট রে তোরা’,
চললে বলেন, থাম। ’
(রূপকথা, লাল ফুলকির ছড়া) 

‘ট্রেন’ কিশোরকবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে শিশুরা খুব আনন্দ পায়। ট্রেন হচ্ছে ছোটদের প্রিয় একটি বস্তু বা বিষয়। আর শামসুর রাহমান কী চমৎকারভাবে লিখলেন। যা শিশুদের অন্তরে গেঁথে যায়-
‘ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন। –’ (সংক্ষেপিত)

এভাবেই তিনি শিশুদের মনে গেঁথে আছেন। থাকবেন অনন্তকাল ধরে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।