ঢাকা: ১৭ বছরে তো অনেক দুঃখ, জ্বালা, যন্ত্রণা কষ্ট ভোগ করলাম। ভোগ করতে করতে আমরা শেষ হয়ে গেছি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি ও যাবজ্জীবন দণ্ডিত এক আসামির রিভিউ আবেদন খারিজের পর এমন মন্তব্য করেছেন তার স্ত্রী সুলতানা আহমেদ।
বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আট বিচারপতির আপিল বেঞ্চে আদেশের সময় উপস্থিত ছিলেন এ শিক্ষকের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ ও মেয়ে আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ।
পরে সুলতানা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ১৭ বছরে তো অনেক দুঃখ, জ্বালা, যন্ত্রণা, কষ্ট ভোগ করলাম। ভোগ করতে করতে আমরা শেষ হয়ে গেছি। অনুভূতি আর এখন কী থাকবে। আমরা তো সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। ড. তাহেরকে তো আর ফিরে পাবো না।
‘খুনির দল আমার স্বামীকে নির্মমভাবে বর্বারোচিতভাবে খুন করেছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মানুষ মানুষকে খুন করতে পারে এটা আমার ধারণার বাইরে। এখন আমাদের চাওয়া রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়’ বলে মন্তব্য করেন সুলতানা আহমেদ।
এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ সাংবাদিকদের বলেন, তিনজনের পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এর ফলে যাবজ্জীবন দণ্ডিত আব্দুস সালাম তার সাজার বাকি মেয়াদ কারাভোগ করবেন। অপর দুজনের দণ্ড কার্যকর হতে বাধা নেই। তবে সর্বশেষ ধাপে এখন আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারবেন। এরপর কারাবিধি অনুসারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। সাধারণত রায়ের অনুলিপি পৌঁছানোর ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে এটি কার্যকর করার বিধান রয়েছে।
আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী ও নিখিল কুমার সাহা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ।
এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তিন আসামির আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদেশের জন্য ২ মার্চ দিন রাখেন আদালত।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাবির কোয়ার্টারের ম্যানহোলে পাওয়া যায় পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয়ের জের ধরে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ। ৩ ফেব্রুয়ারি নিহত অধ্যাপক তাহেরের ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ মামলায় ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছিল পুলিশ।
এ হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, নাজমুল আলম ও আব্দুস সালাম।
খালাসপ্রাপ্ত দুজন হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী।
২০০৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা আপিল করেন।
শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুই আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য দুই আসামির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন হাইকোর্ট।
ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা দুই আসামি হলেন- একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও নিহত ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম।
ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া দুই আসামি হলেন- নাজমুল আলম ও আব্দুস সালাম।
এরপর আসামিরা আপিল বিভাগে আপিল করেন। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডিত দুই আসামির দণ্ড বাড়াতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
শুনানি শেষে গত বছরের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, আসামিদের স্বীকারোক্তিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, হত্যার এ ষড়যন্ত্রে মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনই মুখ্য এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমাদের এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন শুধুমাত্র প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পেতেই ড. তাহেরকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন। তার ধারণা ছিল ড. তাহের বেঁচে থাকলে অধ্যাপক হিসেবে তার পদোন্নতি পাওয়া সম্ভব না।
আমাদের এও বলতে দ্বিধা নেই যে, আপিলকারী জাহাঙ্গীর আলম এবং আবেদনকারী আব্দুস সালাম ও নাজমুল আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য অধ্যাপক তাহেরকে হত্যার জন্য ড. মহিউদ্দিনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন।
১৫ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এরপর মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম এবং যাবজ্জীবন দণ্ডিত সালাম রিভিউ আবেদন করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২৩
ইএস/আরবি