ঢাকা: নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে জেসমিনের (৪৫) মৃত্যুর পুরো ঘটনা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই তদন্ত চলাকালে ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট র্যাব সদস্যদের সরিয়ে হেডকোয়ার্টারে নিতে বলা হয়েছে।
৬০ দিনের মধ্যে এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে নওগাঁ জেলা জজ আদালতের দুইজন বিচারককে রাখতে বলা হয়েছে।
ওই ঘটনায় করা রিটের শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রিটের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। তিনি আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও সুরতহাল প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন।
গত ২২ মার্চ নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে সুলতানাকে আটক করা হয়। এরপর শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকাল ৯টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই নারীর মৃত্যু হয়। সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চন্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সহকারী পদে চাকরি করতেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ভাষ্য, সুলতানা জেসমিনের নামে প্রতারণার অভিযোগ ছিল। সে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করা হয়েছিল।
রাজশাহী র্যাব-৫ এর কোম্পানি কমান্ডার জানান, সুলতানা জেসমিনের নামে আর্থিক প্রতারণার একটি অভিযোগ পাই। তার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক টাকা লেনদেনের অভিযোগ ছিল। পরে তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করে আমরা অভিযোগের সত্যতা পাই। অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে র্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়।
আটকের পরপরই সুলতানা জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ শুক্রবার স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৫ মার্চ দুপুরে স্বজনদের কাছে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
র্যাবের এ কর্মকর্তা আরও জানান, আটকের পর ওই নারীকে র্যাবের কোনো ক্যাম্পে নেওয়া হয়নি। আটক করার পর পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পরিবারের লোকজন সঙ্গেই ছিলেন।
তবে সুলতানার মামা ও নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক (মন্টু) জানান, সুলতানার সঙ্গে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয় ১৭ বছর আগে। এরপর সে তার এক সন্তানকে অনেক কষ্ট করে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে লালন-পালন করে আসছিলেন। নওগাঁ শহরের জনকল্যাণ এলাকায় একটা ভাড়া বাড়িতে থেকে ছেলেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছিলেন। তিনি ভূমি অফিসের একজন সামান্য কর্মচারী। কোনো দিন তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের অভিযোগ কেউ করতে পারেনি।
এ অবস্থায় ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন ২৭ মার্চ হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। এদিন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় নথি চান এবং আইনজীবীকে এ বিষয়ে আবেদন করতে বলেন। সে অনুসারে আইনজীবী ওই ঘটনা তদন্তে একজন অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি চেয়ে রিট করেন। আর অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়োজনীয় নথি আদালতের সামনে তুলে ধরেন। এরপর আদালত দুটি আইনি প্রশ্নের জবাব ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চেয়ে শুনানি ৫ এপ্রিল পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
এদিকে সোমবার (৩ এপ্রিল) গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন জানান, সুলতানা জেসমিনের মরদেহের ময়নাতদন্তের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তারা ফরেনসিক বিভাগের তিনজন বসেছিলেন। বোর্ড বসিয়ে তারা সেই রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করেছেন। তারপরই এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছেন। এরপর সেই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন রোববার বিকেলে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তিনি বলেন, আটকের পর মানসিক চাপ থেকেই তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। আর এই কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে আমরা তার শরীরে দুটো জখম পেয়েছি। যা খুবই ছোট। এর একটা হচ্ছে কপালের বাম পাশে ছোট কাট। যেটার পরিমাণ ২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ ১ ইঞ্চিরও কম। এছাড়া ডান হাতের কনুইয়ের ভেতর দিকে একটি ফোলা জখম ছিল। যেটার সাইজ ২ সেন্টিমিটার। এটা সাধারণত চিকিৎসা গ্রহণের জন্য রোগীর হাতে ক্যানোলা করার সময় হয়। শরীরের শিরা-উপশিরা খুঁজে না পাওয়া গেলে একাধিকবার সিরিঞ্জিং করা হয়। তখন এই ধরনের সোয়েলিং (ফোলা) হয়। তাই জেসমিনের মরদেহের ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত মতামতে আমরা বলেছি- এই যে দুটি ইনজুরি রয়েছে তা মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট নয়। তার মৃত্যু হয়েছে শক ( মানসিক চাপ) থেকে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণেই।
রামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন আরও জানান, সুলতানা জেসমিনের মরদেহের ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রথমে গিয়েছিলেন ফরেনসিক বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. তাজনীন জাহান। তারই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার কথা ছিল। তবে তিনি বিভাগীয় প্রধানকেও মর্গে ডাকেন। তার ডাকে বিভাগীয় প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন আরেক প্রভাষক জামান নিশাত রায়হানকে সঙ্গে নিয়ে মর্গে যান। পরে জেসমিনের মরদেহ তারা একসঙ্গে দেখেন। এর পর তিনজনের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০২৩
ইএস/এমএইচএস