ঢাকা: ফৌজদারি মামলায় উভয় পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তি-তর্কের পর রায় ঘোষণার আগে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে উপযুক্ত বা আনুপাতিক সাজা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতকে আলাদা শুনানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ রায়ের বিষয়টি জানিয়ে সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের প্রতি সার্কুলার জারি করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যশোরের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
গত বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। ৮৪ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘মামলায় যখন উভয় (বাদী-বিবাদী) পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তি-তর্ক শেষ হবে, তখন অভিযুক্তকে দণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে উন্মুক্ত আদালতে বিচারককে সে অভিমত বিচারক জানাতে হবে। এরপর বিচারক অভিযুক্তের শাস্তি বা সাজার বিষয়ে শুনানির জন্য সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে একটি তারিখ নির্ধারণ করে দেবেন, যাতে উপযুক্ত বা আনুপাতিক সাজা আরোপ করা যায়। ’
‘আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় আপিল বিভাগের রায় উদ্বৃত হকরে হাইকোর্টের এ রায়ে বলা হয়েছে, ‘সাজা নির্ধারণের শুনানিতে পক্ষগুলোকে অভিযুক্তের অপরাধের সামাজিক প্রেক্ষাপট, অভিযুক্তের বয়স, চরিত্র, অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যক্তি বা সমাজের অভিঘাত, অপরাধের ধরণ অর্থাৎ অভিযুক্ত অভ্যাসগত, পেশাদার অপরাধী কিনা, নাকি আকস্মিক অপরাধী ইত্যদি বিষয় তুলে ধরতে হবে। ’
সাজা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচারকের মূল্যায়ন কি হবে, তা তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে, ‘সে শুনানির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি সাজা আরোপের ক্ষেত্রে বিচারককেও অপরাধীর এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। সেই সঙ্গে অভিযুক্তের ওপর শাস্তি আরোপের প্রভাব, বিলম্ব বিচারে অভিযুক্তের মানসিক পীড়ন এমনকি অপরাধীর সংশোধনের বিষয়টিও ভাবতে হবে। এরপরেই কেবল বিচারক অভিযুক্তের সাজার রায় ঘোষণা করতে পারবেন। ’
প্রায় এক দশক আগে যশোরে চতুর্থ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে আনোয়ার হোসেন ও লাভলু নামে দুইজনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৪ মার্চে মামলা হয়। দুই আসামির মধ্যে আনোয়ার মারা গেলে ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল লাভলুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
বিচারের পর ২০১৭ সালের ৩০ মে এ মামলার রায় দেন যশোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে লাভলুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে নিয়ম অনুযায়ী লাভলুর মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য রায়সহ মামলার নথি হাইকোর্টে আসে, যা ডেথরেফারেন্স নামে পরিচিত। লাভলুও রায়ের বিরুদ্ধে জেল আপিল করেন। এই ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির পর গত ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালত ডেথ রেফারেন্স খারিজ ও লাভলুর আপিল আংশিক গ্রহণ করে রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে লাভলুকে যাবজ্জীন কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট।
এ মামলার রায়ে এমন নির্দেশনা আসে।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির দেশে ‘অভিন্ন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ’ একটি ‘সেনটেনসিং গাইডলাইন’ বা ‘সাজা প্রদান নীতিমালা’ করার নির্দেশনা চেয়ে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। সে রিটে প্রাথমিক শুনানির পর আদালত ওই বছর ১৯ সেপ্টেম্বর রুল দেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী দেশে ‘অভিন্ন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ’ একটি ‘সেনটেনসিং গাইডলাইন’ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, হাইকোর্টের এ রায়টি যুগান্তকারী। এ রায়েও সাজা আরোপে নীতিমালা করার তাগিদ রয়েছে।
তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলায় আসামির সাজা নির্ধারণের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এ রায় বিচারিক আদালতের বিচারকদের আন্তরিক ও মনযোগী করে তুলবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২৩
ইএস/এএটি