ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০ রবিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

মঞ্জুর হত্যার ৪২ বছর: আইনি ঘুরপাকে আটকা বিচার

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৪ ঘণ্টা, জুন ১, ২০২৩
মঞ্জুর হত্যার ৪২ বছর: আইনি ঘুরপাকে আটকা বিচার

ঢাকা: ১৯৮১ সালে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর হত্যার পর কেটে গেছে ৪২ বছর। মামলার মূল আসামি তৎকালীন সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদসহ একাধিক আসামির মৃত্যু হয়েছে।

তথাপি শেষ হচ্ছে না মামলার বিচার।  নানা আইনি ঘুরপাকে বিলম্বিত হচ্ছে বিচারকাজ।

মামলা দায়েরের ২৮ বছরে শেষ হয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলেও আইনি জটিলতা এখনো বাঁধা হয়ে আছে বিচারকাজে। এ মামলায় আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বৃহস্পতিবার (১ জুন) দিন ধার্য রয়েছে। তবে একজন আসামির পক্ষে বিচারকাজ স্থগিত থাকায় এদিন মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম চলা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

পুরান ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে অস্থায়ী এজলাসে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দিলারা আলো চন্দনার আদালতে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার দায়িত্বে আছেন আইনজীবী আসাদুজ্জামান খান রচি।

মামলার সবশেষ অবস্থা নিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়েরের ১৯ বছর পর বিচারিক কাজ শেষে ২০১৪ সালে তা রায়ের পর্যায়ে এসেছিল। সেখান থেকে পুনঃতদন্তের পর দ্বিতীয় দফায় মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষে ৩০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।
বিচারিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী এখন ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন। সেজন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য রয়েছে।  

তবে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা এখনো শেষ হয়নি জানিয়ে আসাদুজ্জামান খান রাচি বলেন, ‘এ মামলার অভিযোগ গঠন চ্যালেঞ্জ করে আসামি অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমান শমসের হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট তখন এ আসামির ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেছিলেন। এই স্থগিতাদেশ এবং রুলটি কী পর্যায়ে আছে তা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ বিষয়েও আজ আদালতে তথ্য আসার কথা। স্থগিতাদেশ না থাকলে আদালত তার বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন। ’

ঘটনার বিবরণীতে জানা যায়, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী সৈন্যের গুলিতে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি ছিলেন। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের হাতে আটক হন জেনারেল মঞ্জুর। পুলিশ হেফাজত থেকে ১ জুন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নেওয়ার পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, মঞ্জুরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জিয়া হত্যায় জড়িয়ে সামরিক হেফাজতে নিয়ে তড়িঘড়ি হত্যা করা হয়েছিল।

ঘটনার ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন মঞ্জুরের ভাই আবুল মনসুর আহমেদ। ওই বছরই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তখনকার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অভিযোগপত্র দাখিল করলে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন- ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান আবদুল লতিফ, মেজর (অব.) কাজী এমদাদুল হক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শামসুর রহমান শামস ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামাল উদ্দিন।

মামলার দায়ের পর ১৯৯৫ সালের ১ মার্চ আসামি এমদাদুল হক, ১২ মার্চ মোহাম্মদ আবদুল লতিফ ও শামসুর রহমান এবং ১৮ জুন মোস্তফা কামালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অপরদিকে কারাগারে থাকা এরশাদকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল ওই বছরের ১১ জুন। আসামিরা সবাই জামিনে ছিলেন। বাকি তিন আসামিও বর্তমানে জামিনে আছেন। এর মধ্যে এরশাদ ছিলেন মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত প্রধান আসামি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে- ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নির্দেশে কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছেন।

২০১২ সালের অক্টোবরে এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া বক্তব্যে আসামি সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ আদালতে বলেন, জেনারেল মঞ্জুরকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার রেডিও টিভিতে পাঁচ লাখ টাকা ঘোষণা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ওই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ধরা পড়ার পর মেজর মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনার পথে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

রাজনীতির নানা বাঁক বদলেছে এই মামলার বিচারের গতি। সব বাঁধা পেরিয়ে ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক হোসনে আরা আকতার ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তার কয়েক দিন আগে, ২৯ জানুয়ারি আদালতের বিচারক পরিবর্তন করায় নতুন বিচারক ওই তারিখে রায় না দিয়ে নতুন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ দেন।

ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি ছিল সেই ধার্য তারিখ।  সেদিন তদন্তে ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত না করা, গণমাধ্যমে আসা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলাটি অধিকতর তদন্ত চেয়ে আবেদনটি করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আসাদুজ্জামান খান রচি। রাষ্ট্রপক্ষের সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।

মামলাটির পুনঃতদন্ত চলাকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই মারা যান। ২০২০ সালে মারা যান ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান আবদুল লতিফ। পরে ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি পুনঃতদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন। দুই আসামি মারা যাওয়ায় ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি তাদের আসামির তালিকা থেকে বাদ দেন আদালত।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৮ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০২৩
কেআই/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।