ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

জামিনে থাকা আসামি গ্রেপ্তার: পুলিশের ৪ সদস্য নিয়ে যা বললেন হাইকোর্ট

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০২৩
জামিনে থাকা আসামি গ্রেপ্তার: পুলিশের ৪ সদস্য নিয়ে যা বললেন হাইকোর্ট

ঢাকা: পটুয়াখালী ও শরীয়তপুরে জামিনে থাকা কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করায় সংশ্লিষ্ট চারজন পুলিশ সদস্যের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।

পৃথকভাবে সোমবার আদালতের তলবে হাজির হওয়ার পর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ উষ্মা প্রকাশ করেন।

  

শরীয়তপুর

জামিনে থাকা ছিনতাই মামলার আসামিদের আটক, নির্যাতনের পর গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তুলে রিমান্ডে নেওয়ার অভিযোগের ব্যাখ্যা জানতে গত ১৩ জুন হাইকোর্ট তাদের তলব করেন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চেয়ে এক আসামি আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর ওই আদেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। পাশাপাশি নিম্ন আদালতের বিচারককে তলব করেন।

এরপর তারা হাইকোর্টে হাজির হন।

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানানো হয়, আসামিদের গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট শরীয়তপুরের পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।

তবে এ ব্যাখ্যায় উষ্মা প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, সাময়িক বরখাস্তই শেষ কথা হতে পারে না। তারা যা করছে তাতে সাময়িক বরখাস্ত যথেষ্ট নয়। হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার পর কীভাবে রিমান্ড চাইতে পারে! 

আদালতে শরীয়তপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সালেহুজ্জামানের পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুল আলমের ব্যাখ্যা  আদালতে উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।

আর শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।

আসামিদের আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান।

শুনানির পর আদালত শরীয়তপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আগামী ৬ আগস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ রাখেন।

পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী জানান, সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে, তদন্ত হবে। দোষ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আদালতকে এ বিষয়টি হলফনামা করে জানানো হয়েছে।

শরীয়তপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যাখ্যার বিষয়ে সারওয়ার হোসেন বলেন, ওনার পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল স্যার বলেছেন, সেদিন রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেননি। দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিম। তখন আদালত সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমকে ডেকেছেন। আগামী ৬ আগস্ট তাকে আসতে বলা হয়েছে।  

দুই পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক জানান, আসামিরা যে জামিনে আছেন, সে তথ্য এই পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ছিল না। আর আসামিদের গ্রেপ্তারে তাদের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ ছিল না।  

পটুয়াখালী

গত ২০ মে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘জামিন নেওয়া শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার, আদালতে মুক্তি’ শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়। পরদিন সংবাদটি আদালতের নজরে আনেন উচ্চ আদালতে আসামিপক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা।

গত ২১ মে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। একই সঙ্গে ব্যাখ্যা জানাতে পটুয়াখালী সদর থানার ওসি মনিরুজ্জামান ও এএসআই মিজানুরকে ১৮ জুন আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। সেই আদেশ অনুসারে ১৮ জুন তারা হাজির হন। পরবর্তীতে গতকাল রোববার ও  আজ সোমবার তারা আদালতে হাজির হন। ওই ঘটনার জন্য তারা লিখিতভাবে নিঃশর্ত ক্ষমাও প্রার্থনা করেছেন।

আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবু রেজা মো. কাইয়ুম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।

শুনানি নিয়ে আদালত ৩০ জুলাই পরবর্তী আদেশের জন্য দিন রেখেছেন।

শুনানিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী আবু রেজা মো. কাইয়ুম খান বলেন, হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে রাতে লঞ্চে করে আসামি পটুয়াখালী যান। সকালে সার্টিফিকেট (জামিন মঞ্জুর–সংক্রান্ত আইনজীবীর দেওয়া সার্টিফিকেট) থানায় দেবেন। থানায় দাখিল করলে ওয়ারেন্ট অফিসার যেতেন না।

তখন আদালত বলেন, আগাম জামিন দেওয়া হয়েছে। আইনজীবী সার্টিফিকেট দিয়েছেন। যখন নলেজে এলো, তখন কী করলেন? আসামির আইনজীবীর সঙ্গে টেলিফোনেও কথা হয়েছে, এটি সত্য কি মিথ্যা?’

দুই পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী বলেন, ওসিকে ফোন দিয়েছিলেন। তিনি মিটিংয়ে ছিলেন, বিষয়টি দেখবেন বলেছেন।

আদালত বলেন, আইনজীবীর সার্টিফিকেট অভিযুক্ত ব্যক্তি দেখিয়েছেন, এটি উপেক্ষা করেছেন। টেলিফোনে কথোপকথনের ভার্সন কল করি, দেখি কী কথা হয়েছে?
তখন দুই পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী বলেন, বলছি, কথা বলেছেন।

দুই পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী আবু রেজা মো. কাইয়ুম খান বলেন, সবকিছুর জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে অনেক ভুলই হতে পারে। তাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল, ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকবেন।

একপর্যায়ে আদালত বলেন, দেশের মালিক জনগণ। সবারই কাজ জনগণের যাতে কষ্ট না হয়। এভাবে আপনি (ওসি) লাইন কেটে দিলেন।  

তখন দুই পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী বলেন, ফোন লাইন কাটেননি। মিটিংয়ে ছিলেন।

আদালত বলেন, আপনারা কি নিজেরাই মালিক হয়ে গেছেন?

তখন পুলিশের দুই কর্মকর্তার আইনজীবী বলেন, অবশ্যই নয়। আদালতের প্রতিটি আদেশ আমরা মেনে চলতে বাধ্য।

এ সময় আদালত বলেন, মিটিং শেষ হওয়ার পরও প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেননি।

আইনজীবী বলেন, সেখানে ভুল হয়েছে।

আদালত বলেন, এ দেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে। জামিন দেওয়ার পর কোর্টে তুলবেন, এ কারণে কি দেশ স্বাধীন হয়েছে? মালিক হয়ে গেছেন?’

তখন পুলিশের দুই কর্মকর্তার আইনজীবী বলেন, না, মাই লর্ড।  

পরে আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য রোববার দিন রাখেন। সেদিন পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে আদালতে উপস্থিত থাকতে বলেছেন আদালত।

গত ২০ মে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘জামিন নেওয়া শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।  

প্রতিবেদনে বলা হয়, পটুয়াখালী সদর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়া কলেজ শিক্ষার্থী মো. আশ্রাফুল হাওলাদারকে আটক করে আদালতের পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার (১৮ মে) রাতে আসামির বাড়ি থেকে আটকের পর শুক্রবার সকালে আদালতে পাঠানো হয়। এ সময় পুলিশকে হাইকোর্টের জামিনের কপি দেখালে তা আমলে নেয়নি বলে দাবি আসামির পরিবারের। পরিবারের অভিযোগ, আটকের পর পুলিশ মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তা দিতে না পারায় পুলিশি ক্ষমতার বলে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। যদিও হাইকোর্টের জামিননামা দেখে শুক্রবার দুপুরে আসামিকে ছেড়ে দিয়েছেন পটুয়াখালী চিফ জুডিশিয়াল আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মো. জামাল হোসেন। আশ্রাফুল হাওলাদার পটুয়াখালী সদর উপজেলার মরিচবুনিয়া ইউনিয়নের বাজারঘোনা গ্রামের আব্দুল লতিফ হাওলাদারে ছেলে। এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন জেলা আইনজীবী সমিতি।  

আশ্রাফুলের চাচা রাজা মিয়া বলেন, বৃহস্পতিবার সদর থানা পুলিশের এএসআই মিজানুর রহমান আশ্রাফুলকে আটক করেন। আশ্রাফুলের পরিবার ওই রাতে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আলী আহসান মোল্লার স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্র ও জামিননামার অনলাইন কপি দেখায় পুলিশকে।

এ প্রসঙ্গে এএসআই মিজানুর রহমান বলেন, আমি ওয়ারেন্ট অনুযায়ী আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। এরপর আশ্রাফুলের পরিবার ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ওসি স্যার কাগজপত্র দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ওই প্রতিবেদন ২১ মে আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা।

বাংলাদেশ সময়: ২৩৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০২৩
ইএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।