ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইন ও আদালত

২৬ বছর ধরে ঝুলছে সীমা হত্যার বিচার

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৯ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৪
২৬ বছর ধরে ঝুলছে সীমা হত্যার বিচার

ঢাকা: সাক্ষী না আসায় ২৬ বছর ধরে ঝুলছে ঢাকার তৎকালীন লালবাগ থানার জগন্নাথ সাহা রোডের সীমা মোহাম্মদী হত্যা মামলা। দীর্ঘ ২৬ বছরে মাত্র ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করতে সক্ষম হন আদালত।

মামলার দীর্ঘসূত্রতায় মারা গেছেন মামলার বাদী নিহত সীমার মা ইজহার মোহাম্মদী।
 
বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় ১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল নিজ বাসায় নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল সীমাকে।
 
সেই থেকে ২৬ বছর পার হয়েছে। ১০ জন বিচারক বদলি হয়েছেন। ৯টি সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। প্রত্যেক সরকারে সরকারি কৌসুঁলি পরিবর্তন হয়েছে। ৬৪ বার মামলার তারিখ পড়েছে। সাক্ষীদের হাজির করতে ২১টি তারিখে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে , কিন্তু মামলার বিচার শেষ হয়নি।
 
আর মামলার দীর্ঘসূত্রতায় মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি তার মা-বাবা।
 
২৬ বছরে যেমন সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ, তেমনি গ্রেফতারও করতে পারেনি মামলার একমাত্র আসামি মোহাম্মদ আহাম্মদ ওরফে আমিনকে। মামলার শুরু বিচার চলাকালে ২৬ বছর ধরে তিনি পলাতক আছেন।
 
হত্যাকাণ্ডের ২০ বছর পর ২০০৮ সালের ২৮ মে মামলার সাক্ষ্য দেন নিহত সীমার বড় ভাই মবিনুর রহমান। পরের বছর ২১ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন নিহতের ছোট বোন তাবাসসুম মোহাম্মদী। ঘটনার সময় তখন তার বয়স ছিল ১৩ বছর। তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।
 
যেভাবে খুন হন সীমা মোহাম্মদী
১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর তৎকালীন লালবাগ থানার ১৬৬ নম্বর  জগন্নাথ রোডের বাসায় খুন হন সীমা মোহাম্মদী। এ ঘটনায় ওইদিনই নিহতের মা ইজহার মোহাম্মদী লালবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
 
মামলার এজাহারে বাদী অভিযোগ করেন,- সেদিন সকাল সাড়ে ৯টায় কলিং বেলের শব্দ পেয়ে আমার ছোট মেয়ে তাবাসসুম মোহাম্মদী গেট খুলে দেয়। তার পেছনে ছিল আমার মেজ মেয়ে সীমা মোহাম্মদী। তাবাসসুম দরজা খুললেই সজোরে ধাক্কা দিয়ে একটি লোক জোর করে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়ে। দরজার ধাক্কায় তাবাসসুম পড়ে যায়।
 
পরে লোকটি হাতে থাকা ডেগার দিয়ে আমার মেজ মেয়ে সীমা মোহাম্মদীকে দৌড়িয়ে উঠানে নিয়ে আসে এবং ডেগার দিয়া সীমাকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে।
 
সীমার চিৎকার শুনে আমি বাথরুম থেকে দৌড়ে আসি। আমার আগমন টের পেয়ে লোকটি পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়। পালিয়ে যাওয়ার সময় আমি ও অামার মেয়ে তাবাসসুম লোকটিকে চিনতে পারি। তার নাম মোহাম্মদ আহাম্মদ ওরফে আমিন।
 
আমি ও আমার ছোট মেয়ে সীমাকে চৌকির ওপর উঠিয়ে দেখি , সে মারা গেছে।
 
মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, মোহাম্মদ আহাম্মদ ওরফে আমিন আমার মেয়ে সীমাকে বিয়ে করার জন্য অনেক আগে থেকেই উত্ত্যক্ত করতো। আমরা তার সঙ্গে সীমাকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলাম না। সীমা খুন হওয়ার ৬ মাস আগে অন্য জায়গার বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়। এরপর থেকেই আসামি আমিন সীমাকে খুন করার হুমকি দিয়ে আসছিল।
 
মামলার তদন্ত
মামলা দায়েরের পর ঘটনাটি তদন্তের দায়িত্ব পান লালবাগ থানার তৎকালীন এসআই মো. আইয়ুব আলী। তার তদন্তে মোহাম্মদ আহাম্মদ ওরফে আমিনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু তাকে গ্রেফতারে ব্যর্থ হন তিনি।
 
ঘটনার ২ মাস পর ওই বছরের ২৫ জুন আসামি আমিনকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে ১১ জনকে সাক্ষী করা হয়।
 
চার্জশিট থেকে জানা গেছে, আসামি আমিন একজন আটকে পড়া পাকিস্তানি। তার পিতার নাম মো. জামিল। বাংলাদেশে তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। ঘটনার ৩/৪ মাস আগে তিনি তার ভগ্নিপতির সঙ্গে মোহাম্মদপুরের শাজাহান রোডের একটি বাসায় বসবাস করতেন।
 
ঘটনার ২ মাস আগে আমিন তেজগাঁওয়ের উর্দু রোডের আল আমিন বোর্ডিংয়ের ৫৫ নম্বর রুমে দৈনিক ২৮ টাকা ভাড়ায় থাকতেন। সীমাকে খুন করার পর ওই বোর্ডিংয়ে আর যাননি আমিন। এরপর থেকে আর তার কোনো হদিস পায়নি পুলিশ।
 
চার্জশিটে সাক্ষী করা হয় নিহত সীমার মা মামলার বাদী ইজহার মোহাম্মদীকে। এছাড়াও সীমার বাবা কফিলুর রহমান, ভাই মবিনুর রহমান, বোন তাবাসসুম মোহাম্মদীকে মামলার সাক্ষী করা হয়।
 
আরও সাক্ষী করা হয় ৬৪, সুবল দাস রোডের বশির আহমেদের ছেলে বাবু মিয়া, ১২০, লালবাগ রোডের আতিক আহম্মেদের ছেলে নইম আহম্মেদ, আল আমিন বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার ইসাহাক মিয়া, সীমার ময়না তদন্তকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডাক্তার মো. আনোয়ার হোসেন, লাশের সুরতহালকারী দারোগা ফরিদ উদ্দিন, মামলার রেকর্ডিং অফিসার এএসআই আ. মান্নান ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আইয়ুব আলীকে।
 
বিচার
চার্জশিট দাখিলের পর আসামি পলাতক থাকায় মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত করতে ঢাকার সিএমএম আদালতের লেগেছে এক যুগ। আসামির মাল ক্রোক ও তার অনুপস্থিতিতে বিচার শুরুর জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতেই কেটেছে এতোগুলো বছর।
 
ঢাকার জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি আনোয়ার সাদাত শাওন বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল সীমা খুন হওয়ার ২ মাস পর ২৫ জুন মামলাটির চার্জশিট দেওয়া হয়। এ মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত করতে এক যুগ সময় নেওয়াটা দুঃখজনক। ছয় মাসের মধ্যে সব প্রস্তুত করতে পারতেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
 
তিনি আরও বলেন, বাদীপক্ষ হয়তো ‘তদবির’ করতে পারেননি বলেই মামলাটি এতোদিন পড়ে ছিল।
 
এরপর মামলাটি বিচারের জন্য বদলি হয় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে। মহানগর দায়রা জজ মামলাটি ফের বদলি করেন ৫ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। ওই আদালতে ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল আসামি মোহাম্মদ আহাম্মদ ওরফে আমিনকে পলাতক দেখিয়ে চার্জ গঠন করেন তৎকালীন বিচারক হাবিবুর রহমান।
 
মামলাটি বর্তমানে ঢাকার জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আছে। বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ফারুক আহাম্মদ।
 
এরপর গত ১৩ বছরে মামলাটির তারিখ পড়েছে ৬৪টি। ১০টি তারিখ যাওয়ার পর মামলার চার্জ গঠিত হয়েছে। আর ৫৪টি তারিখ ধরে সাক্ষীদের প্রতি সমন, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করে চলেছেন আদালত।
 
এর মধ্যে ২টি তারিখে দুইজন সাক্ষী নিহতের ভাই মবিনুর রহমান ও বোন তাবাসসুম মোহাম্মদী এসে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকি ৫২টি তারিখে সাক্ষী আনতে সময়ের আবেদন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
 
সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পিপি আনোয়ার সাদাত শাওন বলেন, সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। প্রথমে থানার মাধ্যমে, এরপর ডিএমপি কমিশনারের মাধ্যমে ও পরে আইজিপির মাধ্যমের সাক্ষীদের প্রতি অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। তারপরও পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারেনি।
 
মামলার বাদী নিহতের মা ইজহার মোহাম্মদী মারা গেছেন এমন প্রতিবেদনও পুলিশ আদালতে পাঠায়নি। ফলে না জানার কারণে মৃত ব্যক্তির নামেও গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠাতে হয়েছে আদালতকে।
 
শাওন আরও বলেন, মামলার বাদীপক্ষ একদিনের জন্যও আদালতে আসেন না। নিহতের ভাই ও বোন ঘটনার ২১ বছর পর সাক্ষ্য দিতে আদালতে এসেছেন। তাও তাদেরকে আনা হয়েছে ৪০ বারেরও বেশি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
 
পুলিশ প্রশাসন, মামলার বাদীপক্ষ, বিচারকাজে সংশ্লিষ্টদের নিষ্পৃহতায় এভাবেই কেটে গেছে সীমা মোহাম্মদী হত্যার পর ২৬টি বছর।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫  ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।