ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইন ও আদালত

মামলা জট খুলবে কবে? কীভাবে?

মানবাধিকার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৫ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১৪
মামলা জট খুলবে কবে? কীভাবে?

আজকের পৃথিবীতে একটি রাষ্ট্র বা সমাজ কতটুকু উন্নত বা আধুনিক তার একটি বড় মাপকাঠি হলো ওই রাষ্ট্র বা সমাজ তার নিজস্ব পরিসরে ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে কতটুকু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেহেতু প্রশ্নটি ন্যায়বিচারের তাই এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সমাজকেই এর জবাব দিতে হয়।

 

আমাদের বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি আজকে সবচে বড় প্রশ্ন। গণতন্ত্র, সুশাসন, অর্থনৈতিক  উন্নয়ন-ন্যায়বিচারকে এড়িয়ে কোনোটিই সম্ভব নয়। আর আমাদের বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থা এমনই জটিল যে এখানে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক বা সামাজি উন্নয়ন সম্ভব হলেও ন্যায়বিচার থেকে যায় সুদূর পরাহত।

কেবল বিদ্যমান বিচার প্রক্রিয়াই যে বিচার বিলম্ব বা ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে একমাত্র বাধা তা নয়, সেই সাথে যোগ হয়েছে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থা। সবকিছু মিলেই ‘ন্যায়বিচার’ এখানে সহজলভ্যতো নয়ই, বরং সুদূর পরাহত।

এতো কিছুর পরও বিচার বিভাগই আমাদের শেষ ভরসাস্থল। ন্যায়বিচারই আমাদের পরম চাওয়া।

যদিও বলা হয়, যতো সংখ্যক মামলা আছে, সেই পরিমাণ বিচারক আমাদের নেই। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ না। কারণ, বিচার প্রাপ্তি সহজলভ্য করার জন্য বিচারকের দক্ষতা একটি বড় বিষয়। সেই সাথে সদিচ্ছা থাকাও বাঞ্ছনীয়। ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে অনেক জেলাই বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নজির সৃষ্ঠি করতে পেরেছে।
 
যেহেতু ন্যায়বিচার প্রত্যেক নাগরিকেরই দাবী, তাই তৃণমূলে ন্যায়বিচারই বেশি জরুরি। নিম্ন আদালতই প্রধান আলোচ্য। নিম্ন আদালতই দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রধান সুতিকাগার-জনগণের প্রাথমিক আশ্রয়দাতা।

কিন্তু বলা হচ্ছে নিম্ন আদালতে যতো মামলা আছে সেই পরিমান বিচারক নেই। তাই মামলার জট।

বলে রাখা ভালো, বিষয়টি কেবল বিচারকদের ওপরই নির্ভর করে না। এর সাথে জড়িত আছে আরো অনেক অংশীদার। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের ফলেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কেবল একা বিচারক, বা একজন আইনজীবীর পক্ষে সম্ভব নয় এই দু:সাধ্য কাজটি করা।
 
একটি মামলার সাথে জড়িত থাকে দুইটি পক্ষ-বাদী ও বিবাদী ও অনেক অংশীদার-বিচারক, আইনজীবী, আদালতের কর্মকর্তা, পুলিশ ও প্রশাসন। ফৌজদারী মামলায় আরো থাকে আরো অনেক পক্ষ। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ও কখনো কখনো পক্ষ হয়ে যায়। সেটা কখনো প্রত্যক্ষ আবার কখনো পরোক্ষভাবে।

এই সব পক্ষকে খুশি করতে পারলেই আসে আকাঙ্ক্ষিত ন্যায়বিচার। কারণ, তথ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে বিচারক সন্তুষ্ট হলে মামলার রায় দেন, আইনজীবী প্রমাণ করার মতো দলিলপত্র পেলে আদালতে পেশ করেন, অর্থনৈতিকভাবে মক্কেল তাকে খুশি করতে পারলে মামলা চলে না হলে সময় প্রার্থনা (সবক্ষেত্রে নয়), আদালতের অফিসাররা খুশি হলে মামলার তারিখ পরে, পুলিশ খুশি থাকলে তদন্ত কাজ চলে- ইত্যাদি।

সবক্ষেত্রেই যে বিষয়গুলো এরকম তা নয়। তবে জনমনে এরকম ধারণাই আছে। আর public perception অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক না হলেও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র অবশ্যই প্রাসঙ্গিক কারণ কথায় আছে- justice must not only be done--it must be see to be done.

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা একটি পবিত্র ও মহান দায়িত্ব। বিচারকের ঐকান্তিক ইচ্চা ও সততা ছাড়া ন্যায়বিচার সম্ভব নয়।

পাশাপাশি আইনপেশার বর্তমান যে হালহকিকত তাও ন্যায়বিচারের পথে সহায়ক নয়। আইনজীবীদের সততা, জ্ঞান, মেধা, কৌশল ইত্যাদি এখন বইয়ের কথা। আইনপেশা হারাতে বসেছে তার গৌরব। অল্পকিছুসংখ্যক আইনজীবীরাই ধরে রেখেছেন সেই গৌরব। আর বিদ্যমান ব্যবস্থায় নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবীরাও হালে পানি পাচ্ছেন না। তাই ন্যায়বিচারের বিধি বাম। অনেক আইনজীবীর কাছে মক্কেল ধরেই রাখাই ব্রত, ন্যায়বিচার নয়।

বাদী-বিবাদী বা মক্কেল তথা সাধারণ জনগণের আইন ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা এ পথে একটি বড় বাধা। তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সব পক্ষই তাদেরকে ঠকানোর সুযোগ পায়। আদালতের কর্মচারীরা যদি সততার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা না করেন তবে বিচারক বা  আইনজীবীর জন্য একাজটি আরো কঠিন হয়ে পরে।

দেশের পদ্ধতিগত আইনও (procedural law) সময়ের চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধির কিছু কিছু সংস্কার এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন সমন বা ওয়ারেন্ট প্রেরণের জটিলতার কারণে অনেক সময় মামলা শুরু করতেই বিলম্ব হয়।

যিনি সমন প্রেরণ করবেন তিনি যদি দেরি করেন তবে মামলা শুরু হতেই অনেক সময় ৫-৬ মাস লেগে যায়। এক্ষেত্রে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সমন প্রেরক ও কার্যকরকারীর কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই।  

অনেক সময় মামলাকারীও জানেন না মামলা করার পদ্ধতি। তাই তিনি আইনজীবীর স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবী প্রকৃত পক্ষে বিজ্ঞ না হন তবে বাদীর মাথায় হাত। আমাদের দেশের আইনজীবীদের অনেকেই মামলার প্রস্তুতি না নিয়েই আদালতে হাজির হন। শুনানির আগের দিন আইন ও রেফারেন্স বই পড়ে মামলা প্রস্তুতি নেন এমন আইনজীবীর খোজ মেলা ভার।  

মামলা করতে হলে প্রথমেই বাদীকে সুনির্দিষ্ট আদালতে আবেদন করতে হয়। আবেদনের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। তা না হলে মামলা গ্রহণ করা হয় না। কাজেই বাদীকেও সঠিক কাগজপত্র জমা দিয়ে মামলা করতে হবে।

বিবাদীর ইচ্ছাকৃত বিলম্বও ন্যায়বিচারের পথে আরেকটি বড় বাধা। কারণ বিবাদী স্বভাবতই চাইবেন মামলা বিলম্ব করতে যদি তিনি দোষী হন। আর নিদোর্ষ হলে ভিন্ন কথা। তাই তিনি অনেক সময় মামলায় হাজিরা দেওয়া থেকে শুরু করে জবাব প্রদান ও নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করে থাকেন।

আইন কমিশন মামলা জটের কয়েকটি কারণ অনুসন্ধান করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- নিম্ন আদালতে অধিক সংখ্যক মামলা, বিশেষ আদালতের অভাব, পদ্ধতিগত আইনের জটিলতা, বিচারকদের দায়িত্বে অবহেলা, কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাব, আইনজীবীদের সহযোগিতার অভাব ইত্যাদি।

এছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয়কে কমিশন মামলা জটের কারণ হিসেবে মনে করে। উল্লেখ্য, আইনানুযায়ী বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর বিচারক সংখ্যা অনেকাংশেই কমে আসছে। কিন্তু সেই অনুপাতে খুলছেনা মামলার জট।

এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের বিচারকদের অনেক সময় যৌথ দায়িত্বও দেওয়া হয়। তাই কোনো কোনো মামলা পেছেনে পড়ে যায়। বাদী ও বিবাদীর সময় প্রার্থনা, শুনানী স্থগিত এসব কারণ বিচার বিলম্বের একটি বড় কারণ।

মামলার বিচার শেষ হয়ে গেলেও রায় প্রদান বা ডিক্রি জারি করতে অহেতুক দেরি হয়। আদালতের কর্মচারীরা এ বিলম্বের জন্য দায়ী। তাদের দক্ষতাই একটি কারণ বটে। রায় বা ডিক্রি প্রদান করতে অনেক সময় ৬ মাস, একবছরও লেগে যায়।  
বিচার শেষ হয়ে যাওয়ার পরে রায় পেতে দেরি হলে ন্যায়বিচার তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়।

দেশের অন্য অনেক সেক্টর বা বিভাগ ডিজিটাল ব্যবস্থার আওতায় আসলেও তার আঁচ পড়েনি বিচার প্রাঙ্গনে।   প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করেই চলছে আমাদের শত বছরের বিচার ব্যবস্থা। তাই ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থা আজ সময়ে দাবী। এক্ষেত্রে শুভষ্য শীঘ্রম। কিন্তু কবে?

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।