ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন

উন্নয়নের ধোঁয়া ও উষ্ণতার ছোঁয়া

এরশাদুল আলম প্রিন্স | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪
উন্নয়নের ধোঁয়া ও উষ্ণতার ছোঁয়া

২৩ সেপ্টেম্বর শুরু হচ্ছে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন। জাতিসংঘের উদ্যোগেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের জলবায়ু সম্মেলন।

জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রতিবছরই এ সম্মেলন আয়োজন করা হয় যেখানে রাষ্ট্রগুলো তাদের জলাবায়ু বিষয়ক সাফল্য, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করে।

তবে, অন্যান্য বারের সম্মেলন থেকে এবারের সম্মেলন কিছুটা ব্যতিক্রম এইজন্য যে খোদ জাতিসংঘই এর আয়োজক। মহাসচিবই নিজেই এর উদ্যোক্তা। তাই এবার প্রত্যাশার পাল্লা একটু বেশিই ভারি।

একটি টেকসই জলবায়ু ভবিষ্যৎ নির্মানই এ জলবায়ু সম্মেলনের মূল কথা। যদিও এ সম্মেলনে জলবায়ু ছাড়া আরো কয়েকিট এজেন্ডা রয়েছে। সবগুলো বিষয়ই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।   

বাংলাদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। তাই এবারের সম্মেলন নানাভাবেই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী এর আগেও ২০০৯ সালে কপ-১৫ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে তিনি বেশ জোড়ালোভাবেই বাংলাদেশের জলবায়ু প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছিলেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, আরো অন্যান্য দ্বীপ ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তথা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজ নিজ দাবী তুলে ধরেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো একটি কারণের জন্য হয় না। মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, উন্নয়ন ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এ পরিবর্তনের কিছু কিছু বিষয় রোধ করা যায় আবার অনেক বিষয়ইরোধ করা যায়না। তবে, অধিকাংশ কারণ বা উপজীব্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এটাই জলবায়ু পরিবর্তন ও এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মূল বিষয়।

যদিও বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ। কিন্তু আদতে এটি কারণ নয়, এটিও জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ফল। তবে, এর ফলে আবার জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য অনুষঙ্গগুলো আর্বিভূত হয়। বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন একটি চেইন-একটি চক্র। বলা হয়, মানুষের সকল কর্মকাণ্ডই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী।

কিন্তু তাই বলে তো মানুষের কার্যক্রম বন্ধ থাকবেনা। থেমে থাকবেনা তার জীবনচক্র-বেঁচে থাকা। আর মানুষের বেঁচে থাকার অপর নাম উন্নয়ন। বেঁচে থাকতে হলে মানুষেকে উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যেতেই হবে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধান নিয়ামক হচ্ছে এই উন্নয়ন। তবে কি থেমে থাকবে ‘উন্নয়ন’?

বৈশ্বিক উন্নয়নের প্রভাব আছে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর। কিন্তু তারপরও আমরা উন্নয়ন ছাড়া বিশ্ব কল্পনা করতে পারি না। কারণ, উন্নয়ন মানুষের জন্যই। কিন্তু মানুষ যে পরিবেশে বেঁচে থাকে তাকেতো বাসযোগ্য রাখতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন অর্থহীন।

তাই যৌক্তিকভাবে উন্নতরাই উষ্ণতার জন্য দায়ী। ধনী বা শিল্পোন্নত দেশগুলোই প্রধানত এ নির্গমন ও নিঃসরণের জন্য দায়ী যা তাদের উন্নয়নের ফসল। গ্রিন হাউস গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য তারাই প্রধানত দায়ী। এর ফলেই আজকের বৈশ্বিক উষ্ণতা। এর ফলেই সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, মরুকরণ, জীববৈচিত্র ধ্বংস ইত্যাদি। তাদের উন্নয়নের খেসারতই আজকের বৈশ্বিক উষ্ণতা।  

তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার যে হার তা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ  পরিণত হবে জলাবায়ু উদ্বাস্তুতে। উচ্ছেদ হবে ভিটে মাটি থেকে। নিঃস্ব হয়ে পাড়ি জমাতে হবে অন্য কোথাও। এর আর্থ-সামাজিক প্রভাবতো আরো ভয়াবহ। জলবায়ু পরিবর্তনের এ বিশেষ প্র্রভাবের ভয়াবহ শিকার হবে দক্ষিণের ক্ষুদ্র একটি ব-দ্বীপ-বাংলাদেশ।

কিন্তু এর জন্য দায়ী নয় এ জনপদের মানুষ। তারপরও এর ভয়াবহ পরিণতি বরণ করে নিতে হবে আমাদেরই।

ফলে, উন্নত বিশ্বকেই এর দায় স্বীকার করে নিতে হবে ও সেই মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রতি দিতে হবে উন্নত বিশ্বকে। প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাপমাত্রা কমিয়ে আনার বা নিয়ন্ত্রণে রাখার। গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য উন্নত বিশ্বকে অঙ্গীকার করতে হবে।

গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের হার না কমাতে পারলে বা তা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে। তাই আইনের আওতায় আনতে হবে উন্নত বিশ্বকে। প্রতিশ্রুত আদায় করতে হবে তাপমাত্রা সীমার মধ্যে রাখার।

বর্তমানে যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আছে তার লাগাম টেনে না ধরতে পারলে ভবিষ্যতে এ তাপমাত্রা আরো বাড়বে। যদি এখনই এর হার না কমানো যায় তবে ভবিষ্যতে এর পরিণতি মোকাবেলা করার মতো অবস্থা আর আমাদের থাকবে না। সেই সক্ষমতা আমরা অর্জনও করতে পারবো না।
 
কিন্তু দু:খজনক হলো, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য অধিকাংশ উন্নত দেশই আজ পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পদক্ষেপ তো পরের কথা, তাপমাত্রা বিষয়ক ঐকমত্যেই বিশ্ব আজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। বৈশ্বিক তাপ মাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার ব্যাপারে এখনো কেউ সম্মত হয়নি।

কারণ ২০০৫ সালে কিয়োটো প্রটোকলের ব্যর্থতা আমরা এখনো ঘোচাতে পারিনি। এর প্রতিশ্রুত বিষয়গুলো এখনো অর্জিত হয়নি। সেই প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১২ সালে কিন্তু তার পরবর্তী পদক্ষেপ এখনো আমরা নিতে পারিনি। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে রাষ্ট্র্রসমূহ এখনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। এটাই কিয়োটো প্রটোকলের পরিণতি।  

নতুন একটি আইন প্রণয়নের প্রশ্নে রাষ্ট্রসমূহ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। আইন প্রণয়নের জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এ আইনের পালনীয় বিষয়গুলো তাদেরই সম্পাদন করতে হবে। তারা যদি তাপমাত্রা কমানোর জন্য কোনো প্রতিশ্রুতি না দেয় তবে কোনো আইন করা সম্ভব নয়। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দায়-দায়িত্বই হবে এ আইনের মূল বিধান। সে লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যই কাম্য।

আগেই বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে বাংলাদেশকে। কিন্তু সে ঝুঁকি গ্রহণ করতে আমরা আদৌ প্রস্তুত নই। আমাদের সে সক্ষমতা নেই। এর ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিণতি আমরা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই।

যে ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি হবে এই জনপদের মানুষ তা কল্পনাও করা যায়না। কিন্তু তা হ্রাস করা মিটিগেট করার কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ে না। এডহক ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারেনা।  

জলবায়ু উদ্বাস্তু আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি যাতে না হয় সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময় আজই। কিন্তু সে ব্যবস্থা একা করা সম্ভব না। সবাইকে নিয়েই তা মোকাবেলা করতে হবে। উন্নত বিশ্বকে হতে হবে বড় অংশীদার।

আমরা ইতিমধ্যেই এর পরিণতি ভোগ করছি। এ জনপদের বহুসংখ্যক জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চল বা উপকূলয়ী এলাকাগুলো থেকে অনেক মানুষ পাড়ি জমিয়েছে অজানার সন্ধানে। কৃষি জমির অভাব, লবণাক্ততা, খাদ্য ও কর্মসংস্থানের অভাব বাধ্য করেছে ওই জনপদের মানুষকে অন্যকোথাও চলে যেতে। শত বছরের বসৎভিটা পেছনে ফেলে অগ্রসর হয়েছে অনিশ্চিত গন্তব্যে।  

তাই এখনি যদি এর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তবে ২০২০ সাল নাগাদ এ উদ্বাস্তুর পরিমাণ প্রায় দুই কোটিতে পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

তাই উদ্বাস্তু সমস্যা ও বাস্তবতা মোকাবেলার জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলোকে এর দায় স্বীকার করতে হবে। দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে উদ্বাস্তুদের। কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের ফলেই আজকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে উদ্বাস্তু সমস্যাকে।  

বাংলাদেশ এ লক্ষ্যে তার ন্যায় সঙ্গত দাবী তুলে ধরবে। জলবায়ু সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সূচিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এ সম্মেলনে বাংলাদেশ তার ন্যায্য জলবায়ু অধিকার তথা climate justice বা ‘জলবায়ু ন্যায়বিচার’  প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট থাকবে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নের ফলে নিঃসৃত ধোঁয়া ও কার্বনের ফলেই আজকের বৈশ্বিক উষ্ণতা যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো ক্ষুদ্র ও অনুন্নত দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে।

একথা ঠিক দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য আশাব্যঞ্জক। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সাফল্যও উল্লেখযোগ্য। একইভাবে জলবায়ু বিষয়টিও ভবিষ্যতে সমান গুরুত্ব পাবে এটিই কাম্য। বাংলাদেশ এ সম্মেলনে যোগ দিয়ে সেই প্রত্যয়ই ব্যক্ত করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।