ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইন ও আদালত

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনি অধিকার

মানবাধিকার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনি অধিকার

মানুষ ক্রমেই অধিকার সচেতন হচ্ছে। এই সচেতনতা কেবল নিজের অধিকার নিয়েই নয়, অপরাপর মানুষ ও জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়েও আমরা কথা বলছি।

মানবাধিকার মানে সবার অধিকার।

প্রতিবন্ধীরা আর অবহেলার পাত্র নন। এই বিশ্বে তাদেরও সমান সুযোগ ও অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সবার অধিকার ‘মানবাধিকার’র মূল কথা। অধিকার ও মানব মর্যাদার দিক থেকে সব মানুষই সমান। এটাই মানবাধিকারের মূল ধারনা। বিশ্বের সব মানবাধিকার সনদেই এর প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।

কিন্তু প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে- বিশেষ করে যারা প্রতিবন্ধী নয় তাদেরকে।

প্রায় দুই দশক ধরে আমরা যথেষ্ঠ গুরুত্ব সহকার প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে আসছি। দেশে বিদেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগামী। কিন্তু তারপরও প্রতিবন্ধীরা সামাজিকভাবে এখনো পুরোপুরি অধিকারপ্রাপ্ত হয়নি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই এ জন্য দায়ী।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। আর এ ১০০ কোটি জনগোষ্ঠীর আবার বেশিরভাগই আমাদের মতো উন্নয়ন রাষ্ট্রগুলোতে বসবাস করে। তার মানে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। তবে, এই প্রতিবন্ধীতার বিভিন্ন রকমফের আছে। কোনোটি দৃষ্টিগোচর হয়, আবার কোনোটি অতটা প্রকট নয়। তাই ততোটা গুরুত্ব পায়না।

মূলত শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধীদেরই আমরা বিবেচনা করি। প্রতিবন্ধীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। তারা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাই এ বৈষম্য ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মূল কারণ।

একটি অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অসচেতন জনগোষ্ঠী কখনোই প্রতিবন্ধীদের মতো সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করতে পারে না। কারণ, অশিক্ষা বা অসচেতনতার জন্য তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কেই ধারণা রাখেনা। ফলে, ব্যাপকহারে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে। মানবাধিকার লংঘন কেবল হত্যা, খুন বা অপহরণ নয়।   সাধারণ ফৌজদারি বা দেওয়ানি অধিকার রক্ষা করতে না পারাই সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লংঘন।

উন্নয়নের মূল স্রোতে এই প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করতে হলে অবশ্যই তাদের সব রকম সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। সেই সাথে তাদের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমাদের সংবিধানেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা আছে। তাই সংবিধানের আলোকে তাদের জন্য অধিকার বান্ধব একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

মনে রাখতে হবে যে, তারা আমাদেরই একজন। এ পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রে রয়েছে তাদেরও সমান অধিকার ও অবদান।

আন্তর্জাতিক পরিসরে শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোড় দিয়েছে বিশ্ব। বাংলাদেশ এ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষেদের চলমান অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী সে সাফল্যের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই অধিবেশনে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী কন্যা-যিনি দেশে প্রতিবন্ধী অধিকার রক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। শুধু দেশে নয়, আর্ন্তজাতিক অঙ্গনেও তার এ ভূমিকা বিশেষভাবে প্রসংশিত হয়েছে, খ্যাতিলাভ করেছে।  

বাংলাদেশ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০১৩ সালে প্রতিন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন করেছে। ২০১৩ সালের আইনের মাধ্যমে ২০০১ সালের আইনটি রহিত করা হয়েছে।

আইনানুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিতার ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে।

এসব বিবেচনায় প্রতিবন্ধীদের সাধারণভাবে অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাকপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা শ্রেণিভূক্ত করা হয়েছে।

এ আইনের ১৬ ধারায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে। একজন প্রতিবন্ধীর যে সব অধিকার আছে:
-    প্রত্যেক প্রতিবন্ধীর পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়ায়
-    সর্বক্ষেত্রে সমান আইনী স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতার
-    উত্তরাধিকারপ্রাপ্তির
-    স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং তথ্যপ্রাপ্তির
-    মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সাথে সমাজে বসবাসের, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন করার
-    প্রবেশগম্যতার
-    সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে, প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী, পূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের
-    শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণের
-    সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তির
-     কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকবার, অন্যথায়, যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তির
-    নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধাপ্রাপ্তির
-    প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির
-    শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ সুবিধা’ (reasonable accommodation) প্রাপ্তির
-    শারীরিক, মানসিক ও কারিগরী সক্ষমতা অর্জন করে সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে সহায়কসেবা ও পুনর্বাসন সুবিধাপ্রাপ্তির
-    মাতা-পিতা বা পরিবারের উপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাতা-পিতা বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বা তার আবাসন ও ভরণ-পোষণের যথাযথ সংস্থান না হইলে, যথাসম্ভব, নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসনের
-    সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের; শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী, যথাসম্ভব, বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে গ্রহণের
-    ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার
-    স্ব-সহায়ক সংগঠন ও কল্যাণমূলক সংঘ বা সমিতি গঠন ও পরিচালনার
-    জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভোট প্রদান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ
-    সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য যেকোনো অধিকার রয়েছে।

মোদ্দা কথা, একজন প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যাবতীয় অধিকারেরই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে আমাদের বিদ্যমান আইনে। প্রয়োজন কেবল সে আইনের বাস্তবায়ন ও সাধারনের সচেতনতা। প্রতিবন্ধীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে উন্নয়নের অংশীদার করে গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।