ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘গুল’ বিষয়ক আইন

মানবাধিকার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৪
‘গুল’ বিষয়ক আইন

আমাদের চারপাশে গুল মারা ও গুল খাওয়া লোক নেহাত কম নয়। কায়দা করে জায়গা মতো গুল মেরে সমাজে সাফল্য লাভ করেছেন এমন লোকও আছে আমাদের মাঝে।

এ নিয়ে যারা গুল খেতেন তাদের আক্ষেপের অন্ত ছিল না।

তারা এতো গুল খান তারপরও সামাজিক মর্যাদা লাভ করাতো দূরের কথা, সামান্য তামাক সেবনকারীর মর্যাদাও লাভ করতে পারেন নি এতদিন। তাদের প্রিয় গুলকে তারা তামাকের মর্যাদা দিতে পারেন নি।

এজন্য অবশ্য গুলখোড়রা(গুলবাজ নয়)কম দায়ী নয়। গুল একরকম সামাজিক মর্যাদা পেলেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্জনের জন্য তাদের কোনো চেষ্টা ছিল না। তারা কৌশলগত কারণেই গুল নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যও করেন নি। আন্দোলন-সংগ্রামতো অনেক পরের কথা। জঙ্গি মিছিল তো দূরের কথা, একটা মৌন মিছিলও করতে পারেন নি। পাঁচজন সাংবাদিক দাওয়াত দিয়ে দুটো দু:খের কথা বলার চেষ্টাও করেন নি। সবসময় সুবিধা জনক একটি অবস্থানই নিয়েছেন।

সমাজে তারা প্রচার করেছেন গুলই হচ্ছে সব নেশার মূল। বাকি সবই ভুল। আর পরিবারে তারা প্রচার করেছেন, এটাতো কোনো নেশাই না, দাতের মাজন-দাতের ব্যথা ও দুর্গন্ধের এক মহৌষধ। চাইলে তোমরাও নিতে পারো-এসব বয়ান।

এভাবে তারা সমাজে ও পরিবারে একটা অবস্থান করে নিয়েছেন বটে। কিন্তু সে অবস্থান তাদের জন্য খুব সুখকর  ও মর্যাদাশীল হয়নি। সমাজে গুলখোড়রা গুলবাজদের সমান মর্যাদাও পাননি।
 
তাই রাষ্ট্র তাদের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে সম্মত হয়।

সে ফিরিস্তির ইতিটানার আগে ধূমপান ও বিড়ি-সিগারেট নিয়ে দুটো কথা বলা রাখা ভালো।

ধূমপান বিরোধী অভিযান জোরদার ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ বাস্তবায়ন সময়ের দাবী। এর আগে ২০০৫ সালে ধূমপান বিরোধী একটি হলেও এ আইনের কোনো রকম বাস্তবায়ন নেই। ফলে, আইনটি একটি কাগুজে আইনই রয়ে গেছে।

ধূমপান বিরোধী আইন বাস্তবায়নের জন্য জনগণের পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, বিষয়টি জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ।

দেশে তামাক ও তামাকজনিত রোগে প্রতিবছর অর্ধলক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়। এছাড়া নানা ধরনের পঙ্গুত্ব বরণ করে আরো কয়েক লক্ষ লোক। কেবল স্বাস্থ্যগত ক্ষতিই নয়, এর আর্থিক ক্ষতি ও সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রভাব আরো ব্যাপক।

জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ ধূমপানে আসক্ত। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত আছে সব বয়স ও শ্রেণিপেশার মানুষ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এখন ধূমপান চলছে। উঠতি বয়সীদের মাঝে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে ধূমপান ও নানা ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য। শিশুরা এখন ধূমপানসহ নানা মাদকদ্রব্যে আসক্ত। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিশুরা, যাদের বয়স ১৮ বছরের কম-তারাও ধূমপানসহ নানা মাদকে আসক্ত। এছাড়া ভ্রাম্যমান শিশুদের একটি বড় অংশ মাদকে আসক্ত।

দেশের প্রায় ৫০% লোক তামাক সেবন করে। আর অন্যান্য মাদকের প্রধান নিয়ামক হলো ধূমপান। ধূমপান অন্যসব মাদকের পথে এগিয়ে নেয়।   

২০০৫ সালে আমাদের এখানে আইন হলেও তার বাস্তবায়ন নেই। জনসচেতনতাতো নেই বললেই চলে। সরকার বা অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এব্যাপারে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই।

২০১৩ সালে এ আইনটির একটি সংশোধন হয়। প্রয়োজন এখন বিধিমালার। কিন্তু তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। অনেকেই দাবী করছেন, বিধিমালা না থাকায় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার আইনটি বাস্তবায়নে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

তবে, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, ধূমপান নিয়ে যে সাধারণ স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কার্যক্রম থাকার কথা সেটি এখানে একে বারেই অনুপস্থিত। তাই, আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারি নীতি-নির্ধারকদের ধূমপান বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে। এটি আইনের চেয়েও বেশি জরুরি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে যথাযথ নীতি ও কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আইন জরুরি নয়।

সচেতনতামূলক যে বিজ্ঞাপনের কথা আইনে আছে তা পর্যাপ্ত না। বলা আছে, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র সতর্কবাণী মুদ্রণ, সিনেমা বা নাটকে ধূমপানের দৃশ্য দেখানো ইত্যাদি নিষিদ্ধ। কিন্তু এ কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে মূলত কিছু কাজ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু ধূমপানের মতো একটি সহজলভ্য মাদকের হাত থেকে তরুণ ও যুবসমাজকে বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রকে জনসচেতনতামূলক কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু নেতিবাচক পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখলেই চলবে না, প্রয়োজন ইতিবাচক পদক্ষেপ।

টেলিভিশনে বহুদিন ধূমপানের কোনো রকম দৃশ্য দেখানো  হতো না। কিন্তু সম্প্রতি, নাটক ও টেলিফিল্মে ধূমপানের দৃশ্য যেনো অপরিহার্য। যদিও এসব দৃশ্য দেখানোর সময় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করা হয়। কিন্তু সব মিলিয়ে বিষয়টি দর্শকের কাছে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। তাই এরকম দৃশ্য দেখানো থেকে গণমাধ্যমের বিরত থাকা প্রয়োজন।   

আইনে পাবলিক প্লেসের মালিকের দায়িত্ব, তামাকজাত দ্রব্য ধ্বংস ও বাজেয়াপ্তকরণের বিষয়সহ আরো কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু এর বেশকিছু বিধান এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। পাবলিক প্লেসে ধূমপান যে নিষিদ্ধ তা দেখে মনে হয় না।

এছাড়া, বিধিমালার খসড়ায় আছে, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টনে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ছাপতে হবে। ছবি ও লেখার সাইজও বলা আছে। কিন্তু বাজারে প্রাপ্য কিছু পণ্য এ আইনও মানছে না। কিছু কিছু পণ্যের মোড়কে এরকম সতর্কবাণী লেখা থাকে না।  

আইনে আছে, কোনো ব্যক্তি পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে তার জরিমানা ৫০ টাকা । জরিমানা ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার পরও ধূমপান বন্ধ হয়নি।  

আইনের ৪(১) ধারায় আছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করতে পারবেন না৷ কিন্তু, এ আইন কি কেউ মানছে? শুধু তাই নয়, কেউ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরণের অপরাধ করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের (৩০০ টাকার) দ্বিগুণ হারে জরিমানা গুনবেন। কিন্তু এ আইনের বাস্তবায়ন কই?

সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, আমাদের তরুণ-তরুণীদের মাঝে ধূমপানের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনেতো আছে বয়স আঠারো না হলে হাতে ধূমপান নয়। তার হাতে বিক্রেতারা বিড়ি-সিগারেট তুলে দিতে পারবেন না। কিন্তু স্কুল-কলেজগুলোর সামনে যে টং-দোকান বা সিগারেটের স্টল তার প্রধান ক্রেতাই হলো অনুর্ধ্ব ১৮ বছরের তরুণ (আইনে তারা শিশু)। শুধু তি তাই? কোনো শিশু তামাক বা কোনো মাদক বিক্রিও করতে পারবে না। কিন্তু দেখুন, বাস্তবে ওই সব ছোট-ছোট স্টলে কি অনেক শিশুকেই এ কাজে লাগানো হয় না? আমরা প্রতিদিনই এরকম দৃশ্য দেখি, কিন্তু কখনো ভেবি দেখি না এর পরিণাম কতো ভয়াবহ।

আর এ লক্ষ্যে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে তার কোনো প্রয়োগ আজ অবধি দেখা যায়নি।

যারা গুলের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়ায় মনভারি করেছেন, তাদের জন্য খবর হলো এই যে, সরকার তামাকজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে গুলকেও অর্ন্তভূক্ত করেছে। আইনের ২(গ)ধারা এখন গুলসমৃদ্ধ।

এছাড়াও তামাকজাত দ্রব্যের সংজ্ঞায় সিগারেট ও বিড়িসহ অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা, খৈনি ইত্যাদি সংযুক্ত করা হয়। যারা ভাবছেন, ‘আমিতো গুল নেই, সিগারেটতো খাই না’ ‘ধূমপানতো করিনা’-তারাও এ আইনের আওতায়।

গুলখোড়দের রাষ্ট্র এবার আইনের আওতায় এনেছে। যারা পানের সাথে ‘সাদাপাতা’ খান কিংবা, হুক্কা, পাইপ খান-সবার জন্য বিধি বাম! সবাই এবার আইনের আওতায়।

কিন্তু আইনের আওতা যতোই বাড়ুক, এর বাস্তবায়ন না হলে আইন থেকে যায় কাগুজে বাঘ হয়ে। তাই স্বাস্থ্য বিষয়ক জনসচেতনতামূক কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতে হবে। ধূমপানসহ সব মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুস্থ জনসম্পদ মানেই আগামীর আলোকিত বাংলাদেশ।     

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।