ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

নারী নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে আইন

অ্যাডভোকেট মো. মোজাহিদুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪
নারী নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে আইন

লিংগ ভিত্তিক সহিংসতা বা নির্যাতন সারা পৃথিবী জুড়েই রয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

সাংস্কৃতিক, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কিত একটি অবকাঠামোমূলক বৈশিষ্ট্য এটি। লিংগ ভিত্তিক সহিংসতা বা নির্যাতন মানে হচ্ছে লিংগের কারণে কোনো ব্যক্তি বা দলের মধ্যে সহিংসতা বিরাজ করা।

পৃথিবীব্যাপি নারী ও কন্যাশিশুরাই লিংগ ভিত্তিক সহিংসতা বা নির্যাতন-এর মূল শিকার। এধরণের সহিংসতা এক দিকে যেমন নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে অন্যদিকে তা পরিবার, সন্তানাদি এবং অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে কোনো যায়গাতেই কেউ নিরাপদ নয়। এর মধ্যে নারীদের অবস্থা আরো গুরুতর। গৃহে-রাস্তায়-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-শপিংমলে-অফিসে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচেছ না। এর প্রতিবাদ করলে হত্যা পর্যন্ত করছে দুর্বৃত্তরা এবং বিগত সময়ের এমন ঘটনায় দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি না হওয়ায় নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি যুব সমাজকে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহনের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

যদিও ইতিমধ্যে বাংলাদেশের নারী অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তবুও সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী লিঙ্গ সর্ম্পকিত মাপকাঠির বিবেচনায় বৈশ্বিক পর্যায়ে ১৭৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪তম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক পরিচালিত ২০১১ সালের জরিপ মতে ৮৭% নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরণের নির্যাতনের শিকার হন। জাতিসংঘের বিশেষ রির্পোট মতে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন।

২০১৩ সালের আগষ্ট প্রর্যন্ত শুধুমাত্র যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছেন ৩২৭ জন নারী, যার মধ্যে ১১০ জনকে হত্যা করা  হয়,  ৯ জন আত্মহত্যা করেন এবং ২০৮ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ ২০০৮-০৯ সালে ৯৭০টি ময়নাতদন্ত  প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়- সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন বেড়েছে, ইভ টিজিংয়ের মতো ঘটনা ঘটছে ব্যাপকভাবে। অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। এই উপাত্ত থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা এখনও কতটা ভয়াবহ তা সহজেই বোঝা যায়।

নারী নির্যাতন বন্ধে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাশ করা হয় এবং ২০০৩ সালে কিছু সংশোধনী  আনা হয়। এ আইনে বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী ও শিশু অপহরণ, আটক করে মুক্তিপন আদায় বা দাবী, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো, যৌন পীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে অঙ্গহানি করা, ধর্ষণের ফলে জন্মলাভকারী শিশু সংক্রান্ত বিধান সম্বলিত অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো এসেছে।

একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই আইনের অপরাধ গুলোতে শারিরীক আঘাতের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, কিন্তু আমরা মানবাধিকার বলতে বুঝি মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকার। এখানে মর্যাদা বলতে শারিরীক, মানসিক এবং আর্থিক বিষয়গুলো বোঝানো হয়েছে। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানসিক এবং আর্থিক বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয়নি। সুতরাং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ছাড়াও প্রয়োজন হয় নতুন আইনের। তাই জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সিডো সনদ ও শিশু অধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে নারী ও শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এবং ভারসাম্যহীন সমাজব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ও পরিবারে সুস্থ সংস্কৃতি গড়তে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০।

এ আইনে মুল বিষয় গুলো হলো- “পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন ব্যাক্তির দ্বারা পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারিরীক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতি বুঝাবে। ” এখানে পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্ক বলতে রক্তসম্বন্ধীয়, বৈবাহিক সর্ম্পক, দত্তক বা যৌথ পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বাস করছে বা করত তাদের বোঝাবে।

যেকোনো বয়সের নারী এবং ১৮ বছরের কম বয়সের যে কোনো শিশু এ আাইনে সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

আইনটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই আইনে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধের বিষয়টির পাশাপাশি গৃহ অভ্যন্তরে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি যেন সুরক্ষিত থাকতে পারে সেই বিষয়টিও ভাবা হয়েছে যা আইনটির নাম করণের মধ্যেই প্রতিয়মান হয়। এছাড়া এ আইনে
-নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে অংশীদারের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকার অধিকার থাকবে।
- সহিংসতার শিকার নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাসস্থানের আদেশসহ অর্ন্তবর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ প্রদানের সুযোগ রয়েছে।
- আদালত যদি মনে করেন, সুরক্ষা আদেশ বলবত থাকা অবস্থায় অংশীদারীর বাসা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির বা তার সন্তানদের জন্য নিরাপদ নয় তাহলে আদালত আইন প্রয়োগ কারী কর্মকর্তার অধীনে-তত্বাবধানে বা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবেন।
- আদালত যদি মনে করেন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য প্রতিপক্ষকে অংশীদারী বাসা থেকে সাময়িক ভাবে উচ্ছেদের আদেশ দিতে পারবেন।
- আদালত প্রতিপক্ষকে নির্যাতনের শিকার ব্যাক্তির জন্য বিকল্প বাসার ভাড়া দেয়া এবং সে যে যানবাহন ব্যবহার করতো তা অব্যাহত রাখার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। অর্থাৎ নির্যাতনের শিকার ব্যাক্তির এবং তার সন্তানদের ভরণপোষনের জন্য তারা যে পরিবেশে অভ্যস্ত সে ধরণের জীবন ধারণের জন্য প্রতিপক্ষকে ক্ষতি পূরণের আদেশ দিবেন আদালত।
-আইনটিতে ক্ষতিপূরণ এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
-নির্যাতনের শিকার ব্যাক্তি আঘাত, ভোগান্তি, শারিরীক ও মানসিক ক্ষতির প্রকৃতি ও পরিমান, চিকিৎসার করচ, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, সহিংসতার জন্য ব্যয় করা অর্থের পরিমান বিবেচনা করে প্রতিপক্ষকে ক্ষতি পূরণের আদেশ দেবেন আদালত
-নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র এবং স্থানের ব্যবস্থা রয়েছে।
-নিরাপদ আশ্রয় স্থান বলতে সরকার অনুমোদিত বা আদালতের বিবেচনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য নিরাপদ বলে বিবেচিত এমন কোনো আশ্রয় বা বাসা, যে কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে।  
- নিরাপদ হেফাজতের আদেশের ব্যবস্থা রয়েছে, অর্থাৎ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তার বিবেচনায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সন্তানদের তার কাছে বা তার পক্ষে অস্থায়ী ভাবে সাময়িক নিরাপদ হেফাজতে রাখার আদেশ দিবেন।
- বিনা খরচে আদালতের  আদেশের কপি পাওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
- নিভৃত-কক্ষ বিচার (ট্রায়াল ইন ক্যামেরা) এর ব্যবস্থা আছে।

এই আইনে শারিরীক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন ছাড়াও মানসিক নির্যাতন এবং আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি এসেছে। (উল্লেখ্য যে এখানে মানসিক নির্যাতন বলতে মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভয় দেখানো ও এমন কোন কথা বলা, যার মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির মানসিকভাবে ক্ষতিগ্র¯ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, হয়রানি, স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ ও ব্যক্তির ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপকে আইনে মানসিক নির্যাতন বলা হয়েছে)

আইনের অধীনে কর্তব্যরত ব্যাক্তি পক্ষের দায়দায়িত্ব সমূহ:
-সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশ, প্রয়োগকারী কর্মকর্তা ( মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা) এবং সেবা প্রদানকারীর দায়দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।
-পুলিশের কর্মকর্তা পারিবারিক সহিংসতার খবর পাওয়া মাত্র সহিংসতার শিকার ব্যাক্তিকে  আাইন  অনুসারে প্রতিকার, চিকিৎসাসেবা, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে বিনা খরচে আইনি পরামর্শ ও সহায়তা প্রাপ্তিতে সহযোগিতাসহ অন্যান্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন।
-আইনে প্রতিটি উপজেলা, থানা, জেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য এক বা একাধিক প্রয়োগকারী কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।
-প্রয়োগকারী কর্মকর্তা সহিংসতার ঘটনা থানাকে অবহিত করবেন, নির্যাতিত ব্যাক্তি চাইলে আদালতের কাছে সুরক্ষা আদেশের জন্য আবেদন করবেন, আদালতের কাছে প্রতিবেদন পেশসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবেন।
-এই আইন অনুসারে প্রয়োগকারী কর্মকর্তা তাঁর দায়িত্ব পালন না করলে বা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
-আইনে সেবা দান কারী সংস্থা নির্যাতিত ব্যাক্তির অনুমতি সাপেক্ষে নির্যাতনের ঘটনা, আদালত এবং প্রয়োগকারী কর্মকর্তাকে অবহিত করবে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপশি এর রিপোর্ট থানায় এবং প্রয়োগকারী কর্মকর্তা নিকট পাঠাবে, এবং আশ্রয় নিবাসে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য থানা কে জানানো ছাড়াও অন্যান্য দায়-দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।    

আইনের অধীনে দাখিলকৃত আবেদন জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট বা ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটান জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করতে পারবেন। আবেদনকারী বা প্রতিপক্ষের বসবাসের জায়গা, যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে বা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি যেখানে অস্থায়ীভাবে  থাকেন, সেই জায়গার আদালতে আবেদন দাখিল করা যাবে।
ক্ষতিপূরণের আদেশের ক্ষেত্রে আবেদন প্রাপ্তির ছয় মাসের মধ্যে আদালত উক্ত আবেদন নিস্পত্তি করবেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে নোটিশ জারির তারিখ থেকে অনধিক ষাট দিনের মধ্যে আদালত মামলা নিষ্পত্তি করবেন।

তবে প্রয়োজনে আরো সময় বাড়ানো যাবে কিন্তু সময় বাড়ানোর বিষয়টি আপীল আদালতকে অবহিত করতে হবে।

আদেশের বিরুদ্ধে যেকোনো পক্ষ ৩০ দিনের মধ্যে আপীল করতে পারবেন।

সুরক্ষা আদেশের শর্ত না মানলে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক দশ হাজার টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

তবে আদালত যদি মনে করে, প্রতিপক্ষকে শাস্তি না দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের তত্বাবধানে বিভিন্ন ধরণের সমাজ কল্যাণমূলক কাজের আদেশ দিতে পারেন। এই কাজ থেকে যে অর্থ আয় হবে তা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও তার সন্তানদের দেয়ার জন্য আদেশ দিতে পারেন।

কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার জন্য মিথ্যা আবেদন করলে অনধিক ১ (এক) বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড হতে পারে।
আইনটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, চলছে আলোচনা, প্রস্তাবনা এসেছে সংশোধনেরও। যেমন- দেশের সাধারন মানুষ তথা অধিকাংশ আইনজীবী এ আইন সম্পর্কে অবহিত নন; অভিযোগ দায়ের এর পর অংশীদারের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকা যা কোনো পক্ষই মানতে পারছেন না কেননা আমরা মানসিকভাবে এখনও এটা মানতে পারিনি মামলা মানেই শত্রুতা নয়; অন্তবর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ যা শোনামাত্র অভিযুক্ত পক্ষ সম্পর্ক ছিন্ন করার চিন্তা করেন/করতে পারেন; প্রয়োগকারী কর্মকর্তা- আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী- আদালত ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের যথাযথ সমন্বয়ের অভাব;  যাদের জন্য এ আইন তারা এখনও নির্যাতনকে নিয়তি বা প্রাপ্য বলে মনে করে অর্থাৎ সচেতন নয়;  গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারনা; নারীর অনগ্রসরতা বা ক্ষমতায়ন না হওয়া; দেশের বর্তমান প্রচলিত পুরাতন আইন এবং সমাজব্যবস্থায় তৈরি প্রচলিত মানসিকতা; জনবল ও বাজেট স্বল্পতা, আইনটি ব্যবহারে মানসিকতার ঘাটতি, মামলার আদেশ প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনের আওতায় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির মালামাল উদ্ধারে থানার অসহযোগিতা ইত্যাদি। সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভ এগেইনস্ট ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এর এক কর্মশালার জানা যায়- বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিচারকদেরও আইনটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাব আছে, আইনটি আসলেই কতটুকু প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে, তা জানার জন্য জাতীয় পর্যায়ে কোনো নজরদারিরও ব্যবস্থা নেই।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ বাস্তবায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে নারী ও শিশু অধিকার সম্পর্কে জন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করার প্রয়োজন।

সেইসাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের এ আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, প্রয়োগকারী কর্মকর্তা-আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-আদালত ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যথাযথ সমন্বয়, ঘরে বাইরে নারীর অবদান স্বীকার করে নারীর মর্যাদা নিশ্চিত করা, ইউনিয়ন পরিষদের “ পারিবারিক বিরোধ নিরসন ও নারী-শিশু কল্যাণ কমিটি কার্যকর করা, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ব্যাক্তির প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া, আদালতের পরিবেশ নারী ও শিশু  বান্ধব করা, বিয়ের আগে ছেলে ও মেয়ে এবং বিয়ের পর নবদম্পতিদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহন, মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে আলোচ্য আইনটির পাশাপাশি অপরাপর আইনের মাধ্যমে প্রতিকারের উপায়গুলো তৃণমুল পর্যায়ে স্থানীয় নাগরিক সমাজকে জানানোর ব্যবস্থা করা, নারী নির্যাতন তথা পারিবারিক নির্যাতনবিরোধী আইনগুলোর বাস্তবায়ন মনিটর করা সর্বোপরি আইনটি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর সমান অংশগ্রহণের সুযোগ অথাৎ নারী-পুরুস সমতা ও সাম্য ।

আইনটির বয়স মাত্র চার বছর, তাই বলা যায় যতইদিন যাবে এটি ততই পরিপক্ক হবে এবং ভবিষ্যতে বাস্তব প্রয়োগের অভিজ্ঞতার আলোকে সংস্কারের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে। আইন পাসের মাধ্যমে নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়, পরিবার থেকে সকল প্রকার বৈষম্য, বঞ্চনা ও নির্যাতনকে নির্বাসন দিয়ে নির্যাতনমুক্ত পরিবার গড়ে তুলতে পারলে আইনের প্রয়োজন পড়ে না। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন সকলে মিলেমিশে নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিয়ে অধিকারের পাশাপাশি পরস্পর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হলে একটি সহিংসতামুক্ত পরিবার গড়ে তোলা সম্ভব। আর পরিবার থেকে শুরু হোক পথচলা।

লেখক: লিগ্যাল সার্ভিস কোর্ডিনেটর, পিএইচআর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
https://www.facebook.com/banglanewsLaw

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘন্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।