ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

জনস্বার্থে রিট ও জনস্বার্থ মামলা: একটি সরল আলোচনা

অ্যাডভোকেট মোজাহিদুল ইসলাম সুমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৪
জনস্বার্থে রিট ও জনস্বার্থ মামলা: একটি সরল আলোচনা

যাদবপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। ২০০৫ সালে মিজানুর রহমান প্রধান শিক্ষক হিসাবে জয়েন করেন, কোনো সমস্যা ছিল না।

এ বছর জুলাই মাসে শিক্ষা বোর্ড ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন দিয়েছে।

সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু শিক্ষা বোর্ড থেকে একটি চিঠি পান তিনি যাতে বলা হয় ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করা হয়েছে সেই সাথে নতুন করে এডহক কমিটি করতে বলা হয়েছে।

সভাপতির সাথে পরামর্শ করতে গেলে তিনি জানান, কেন বা কোন কারণে এই কমিটি বাতিল করা হলো। সব কিছুতো আইন মেনেই করা হয়েছিল, দরকার হলে মামলা করা হবে, হাইকোর্টে যাব। সভাপতি সাহেবের মতো, মিজানুর রহমান সাহেবের মতো এমন সমস্যা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন বিরুদ্ধ পক্ষ সরকার বা সরকারি কোনো সংস্থা হলে কি মামলা করবেন, কোথায় মামলা করতে হবে ইত্যাদি।

উপরের ঘটনাটি পড়লে একজন আইনজীবী সহজেই বুঝতে পারবেন কে, কোথায়, কেন, কিভাবে মামলা দায়ের করবেন, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের এ সম্পর্কে পুরোপুরি স্পষ্ট ধারণা নাও থাকতে পারে।

আমাদের দেশে আলাদাভাবে আইন বিষয়ে শিক্ষা নেওয়া ছাড়া উচ্চ ডিগ্রি নিয়েও আইনের মৌলিক বিষয় জানার সুযোগ নাই। ভুগোল বা ইতিাসবিদও দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না। অথচ সারা পৃথিবীর সকল নাগরিকের জন্য নিয়মই হচ্ছে ‘Ignorance of law can not be defence’।

এটাও সত্যি আমাদের দেশে শিশু-কিশোর-যুবক বয়সেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইনের সাধারণ বিষয়গুলো জানার কোনো উপায় নেই। রাষ্ট্র আমাদের আইন বিষয়ে জানানোর কোনো দায়িত্ব নেবেনা, নেয়না অথচ আশা করে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত হই না কেন আমি সব আইনই জানবো এবং মানবো!

যা হোক স্বল্প পরিসরে দেশের প্রচলিত আইনের পরিপূর্ণ ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই আলোচনা কেবল জনস্বার্থে মামলা ও এবং রিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

রিট শব্দটির অর্থ হলো আদালত বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঘোষিত বিধান বা আদেশ। রিটের উৎপত্তি ও বিকাশ ইংল্যান্ডে। প্রথমে রিট ছিল রাজকীয় বিশেষাধিকার । রাজা বা রানী বিচারের নির্ধারক হিসেবে রিট জারী করতে পারতেন।
 
পরবর্তীতে রাজা বা রানীর এই বিশেষ অধিকার সাধারণ নাগরিকদের অনুকুলে চলে আসে। নাগরিকগণ সরকারি কোনো সংস্থার কর্মকর্তাদের আচরণ ও কাজে সংক্ষুব্ধ হয়ে রাজার কাছে আসত এবং রাজা তার বিশেষাধিকার বলে তার অফিসারদের উপর রিট জারী করতেন।

পরবর্তীতে রাজা বা রানীর প্রতিনিধি হিসেবে ইংল্যান্ডের দু ধরণের আদালত নাগরিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে রিট জারী করত। তা হলো চ্যান্সারী আদালত এবং কিংস বেঞ্চ।

পাঁচ ধরনের রিট আছে-

বন্দী প্রদর্শন রিট: কোনো ব্যক্তিকে সরকার বা অন্য কেউ আটক করলে কি কারণে তাকে আটক করা হয়েছে তা জানার জন্য বন্দীকে আদালতে হাজির করার যে নির্দেশ দেওয়া হয় তাই বন্দী প্রদর্শন রিট।
 
পরমাদেশ বা হুকুমজারি রিট: কোনো অধ:স্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি তার আইনগত দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করে কিংবা ব্যর্থ হয় তাহলে উচ্চতর আদালত যে আদেশের মাধ্যমে উক্ত আইনগত দায়িত্ব পালন করতে উক্ত আদালত বা ট্রাইব্যুনালকে বাধ্য করে তাকে হুকুমজারী রিট বা পরমাদেশ বলে।

নিষেধাজ্ঞামূলক রিট: কোনো অধস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কোনো কর্তৃপক্ষ, সংস্থা বা ব্যক্তি তার এখতিয়ার বর্হিভূত কাজ করতে উদ্দ্যত হয়েছে কিংবা ন্যায় নীতি ভঙ্গ করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় উচ্চতর আদালত যে আদেশের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে ঐ কাজ করা থেকে বিরত রাখেন তাকে নিষেধাজ্ঞামূলক রিট বলে। নিষেধাজ্ঞামূলক রিটকে বিচার বিভাগীয় রিটও বলা হয়।

উৎপ্রেষণ রিট: দুটি উদ্দেশ্যে উচ্চতর আদালত উৎপ্রেষণ রিট জারী করতে পারে- ক) অধ:স্তন কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক কৃত ক্ষমতা বহির্ভূত কাজকে বাতিল বা নাকচ করে দেয়া। খ) অধ:স্তন আদালত বা ট্রাইব্যুনালের কোনো মামলা শুনানীর জন্য উচ্চতর আদালত নিজেই গ্রহণ করে এ রিট জারী করতে পারে।

কারণ দর্শাও রিট: কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো সরকারি পদ দাবী করে, যে পদের যোগ্যতা তার নাই অথবা অবৈধভাবে যদি কোনো সরকারি পদ দখল করে বসে থাকে, তাহলে উচ্চতর আদালত যে আদেশের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিকে তার পদ দখলের বা দাবীর কারণ দর্শাও নির্দেশ দিয়ে থাকে তাকে কারণ দর্শাও রীট বলে।
 
কারো মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে আমাদের সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ তা বলবৎ করতে পারে এবং বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনাকে কার্যকর করতে পারে।

হাইকোর্ট বিভাগের এই এখতিয়ার কে রীট জারীর এখতিয়ার বলে। অর্থাৎ রিট শুধু মাত্র হাইকোর্ট বিভাগ জারী করতে পারে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে ৪৩ এ উল্লেখিত মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ প্রদত্ত অধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য রিট পিটিশন দায়ের করা যায় এবং হাইকোর্ট বিভাগ ১০২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য কতিপয় আদেশ নির্দেশ জারী করতে পারে, যাকে রিট বলে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে ৪৩ এ আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সমাবেশের অধিকার, সংগঠনের অধিকার, চিস্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, গ্রেফতার বা আটক সর্ম্পকে রক্ষাকবচ ইত্যাদি অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র রাষ্ট্র এ অধিকারগুলো লংঘন করে, কোনো ব্যাক্তি করে না ।

যদিও ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগ কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে তার মৌলিক অধিকার বলবৎ করণের জন্য যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত নির্দেশনা বা আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে সুপ্রীমকোর্টের আন্তরিক ও ইতিবাক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে  “সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি”-এর অর্থে ব্যপকতা এসেছে অর্থাৎ রিট মামলা দায়েরের যোগ্যতার পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

অনুচ্ছেদ ১০২ এ দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি কেবল নিজে সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেই রিট করতে পারে (২)(ক)(অ)-(আ) এবং যে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে হাইকোর্টের নিকট আবেদন করতে পারবেন অনুচ্ছেদ (২)(খ)(অ)-(আ) অনুযায়ি ।

যেহেতু রাষ্ট্রই মেীলিক অধিকার লংঘন করে তাই শুধুমাত্র রাষ্ট্র কিংবা রাষ্টীয় কোনো সংস্থায় কর্মরত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে রিট করা যায়।

হাইকোর্ট এই রিট বিষয়ে অবারিত ক্ষমতা ব্যাবহার করতে পারে অর্থাৎ বিষয় বিবেচনা করে যেকোনো আদেশ দিতে পারে কোনো কিছুই আদালতকে বারিত করে না ।

এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা হলো বেসরকারি কোনো সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারির বিরুদ্ধে রিট করা যায় না অর্থাৎ প্রাইভেট সংস্থা যদি মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে তাহলে তা হবে অপরাধ, তখন রিট মামলা করা যায় না। মামলা করতে হবে দেওয়ানী আদালতে।

ইদানিং হাইকোর্টে রিট মামলার সংখ্যাও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যার বেশির ভাগই  প্রাথমিক শুনানি শেষে রুল জারী হচ্ছে এবং নব্বই শতাংশ চুড়ান্ত শুনানিতে খারিজ হচ্ছে। সে এক অন্য আলোচনা ।

জনস্বার্থে মামলা বা জনস্বার্থমূলক মামলা:

সাধারণভাবে 'জনস্বার্থ' বলতে বোঝায় সাধারন নাগরিকের সাধারণ অধিকার। আর এ স্বার্থ এমন এক স্বার্থ যাতে নির্দিষ্ট একটি জাতির বা গোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। আর জনস্বার্থমূলক মামলা হলো জনসাধারণ বা তার কোনো অংশের অধিকার ও স্বার্থ বলবৎ করার জন্য আদালতে পরিচালিত একটি আইনগত পদক্ষেপ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম জনস্বার্থমূলক মামলা ধারণার প্রচলন শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দী অর্থাৎ ১৮৬০ সালের দিকে ’আইনগত সহয়তা পাওয়ার’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ।

'জনস্বার্থমূলক মামলা' শব্দটি ব্যবহার হয় ষাটের দশকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনগত সহয়তা পাওয়ার আন্দোলনটি ছিল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, দক্ষ ও অত্যন্ত আগ্রহী কিছু আইনজীবীর প্রচেষ্টার ফসল। ভারতে জনস্বার্থমূলক মামলা 'সোশ্যাল অ্যাকশন লিটিগেশন' নামে পরিচিতি। ভারতের বিচারপতি সি.জে মহাজন একটি মামলায় রায়ে বলেন (বিহার রাজ্য বনাম কামেশ্বর সিঃ এ আই.আর ১৯৫২ এস.সি. ২৫২) “জনস্বার্থ” ধারণাটির কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন সম্ভব নয়, এর কোনো স্থির অর্থ নেই, বরং এটি সম্প্রসারণশীল এবং একেক দেশে এই শব্দটির একেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে।

সুতরাং “জনস্বার্থ” ধারণাটির এমন কোন পূর্ব নির্ধারিত পরিধি বা সীমারেখা নেই, যার মধ্যে পড়লেই কেবলমাত্র কোনো বিষয়বস্তু জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলে পরিগণিত হতে পারে।

প্রত্যেকটি মামলার প্রেক্ষিত ও পরিস্তিতিই নির্ধারণ করে তার বিষয়বস্তু জনস্বার্থমূলক হবে কিনা।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২এর বিধিবিধান এবং দেশ-বিদেশের নজিরসমূহের ফলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরাও দীর্ঘদিন ধরে লোকাস্ স্ট্যান্ডই অর্থাৎ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে আসছিল যা ছিল জনস্বার্থে মামলার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম যে মামলায় “লোকাস্ স্ট্যান্ডাই” এর প্রশ্ন উত্থাপিত ও পরীক্ষিত ছিল তা হলো ভারত-বাংলাদেশ সীমানা পুন:নির্ধারণ সংক্রান্ত বেরুবাড়ী মামলা (কাজী মুখলেছুর রহমান বনাম বাংলাদেশ, ২৬ ডি এল আর ১৯৭৪, (এডি) ৪৪।

এই আবেদনটি অসময়োচিত বলে খারিজ হলেও আবেদনকারীর লোকাস স্ট্যান্ডাই স্বীকার করে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ মত পোষণ করেন। এই উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে জনস্বার্থ মামলা শুরু হওয়ারও অনেক আগে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল।

মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ মামলায় আপীল বিভাগ বলেন- “সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি” কথাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় না বরং এটা জনসাধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত অর্থাৎ জোটবদ্ধ বা সমষ্টিগত ব্যক্তিত্বকে বোঝায়।

কিছু উদাহরনের মাধ্যমে জনস্বার্থমূলক মামলা বা জনস্বার্থে মামলা বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যাবে-
সমাজের দরিদ্র, নিরক্ষর, দুস্থ,সচেতন জনগোষ্ঠী এবং অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনস্বার্থমূলক মামলার সবচেয়ে কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে।

সমষ্টিগতভাবেও জনস্বার্থমূলক মামলার মাধ্যমে অসহায় বা সুবিধাবঞ্চিত কোন জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রয়োগ আদায় করা যায়। বিনা নোটিশে ও বিকল্প পুর্নবাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই বস্তি উচ্ছেদের মামলা [আইন ও সালিশ কেন্দ্র বনাম বাংলাদেশ সরকার, ১৯ বি এল ডি ( এইচ সি ডি) (১৯৯৯) ৪৮৯] একটি উদাহরন; পরিবেশ সংশ্লিষ্ট জনস্বার্থমূলক মামলার আর একটি উদাহরণ হলো ফ্যাপ ২০ মামলা।

ওই মামলায় একটি বিতর্কিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের ফলে একটি বিশেষ এলাকার পরিবেশে সম্ভাব্য বিরুপ প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। পরিবেশগত অধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে আদালতের হস্তক্ষেপ প্রার্থনার ক্ষেত্রে জনস্বার্থমূলক মামলা সবচেয়ে উপযোগী পন্থা। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে এলাকার সমগ্র জনগোষ্ঠী দুর্ভোগের স্বীকার হয় কোনো  একক বিশেষ ব্যক্তি নয়। জনস্বার্থমূলক মামলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। শিশুদের প্রাণহানীকর প্যারাসিটামল সিরাপ সংক্রান্ত (সৈয়দ বোরহান কবীর বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য (রিট আবেদন নং ৭০১/১৯৯৩ ) মামলা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ; আদালতের স্বপ্রনোদিত এখতিয়ার জনস্বার্থমূলক মামলার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বৈশিষ্ট্য। যে কোনো উপায়ে বিচারক এমন কোনো ঘটনা যদি জানতে পারেন যার ফলে জনস্বার্থ লংঘিত হয়েছে বা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে তিনি নিজেই সেই লংঘনকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি মামলা শুরু করতে পারেন। যেমন- রাষ্ট্র বনাম জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা ও অন্যান্য  [৪৫এলআর (১৯৯৩) ৬৪৩] যেখানে হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি একটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে নজরুল ইসলামের ১২ বছর ধরে বিনা বিচারে আটক থাকার খবর জানতে পারেন এবং স্বপ্রনোদিতভাবে তার মুক্তির ব্যাপারে রুল জারী করেন ।

জনস্বার্থে মামলা সমষ্টিগত জনগনের সমস্যার সমাধানের একটি কার্যকর পদক্ষেপ হলেও এর সীমাবদ্ধতা হলো বাস্তবায়নে আদালত কোনো আদেশ পালনের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারে, বাধ্য করতে পারে না আবার নির্দেশ পালন না করলে আদালত সর্বোচ্চ আদালত অবমাননার শাস্তি ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।

আপাত: দৃষ্টিতে রীট ও জনস্বার্থমূলক মামলার ধরণ একই রকম মনে হলেও এর ব্যাখ্যায় কিছু পার্থক্য রয়েছে। রিট নির্ভর করে কোনো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার লংঘিত হয়েছে কিনা তার উপর এবং শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিটিই প্রতিকারের আবেদন করতে পারে।

আর জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রে অধিকারের পরিধি এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির (লোকাস স্ট্যান্ডাই) ব্যাখ্যাকে শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। পরোক্ষভাবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি জনস্বার্থে মামলা করতে পারে। যদিও মামলটি রিট পিটিশন আকারেই দায়ের করতে হয় কিস্তু এখানে মৌলিক অধিকারগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহকেও নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বাধ্যকরী করার ব্যাখ্যা দেয়া হয়ে থাকে এবং আদালতের বিবেচনায় এটা অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবার জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন সাংবিধানিক অধিকার। ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠির এই সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা মামলার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। জনস্বার্থ এবং জনস্বার্থের চিন্তা মাথায় থাকলেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। শুধুমাত্র রিট ও জনস্বার্থ মামলা নয়, যেকোনো মামলার ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারকসহ মামলা সংশ্লিষ্ট পক্ষ যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চান তবেই ন্যায়বিচার তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।