গত মে মাসে থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গলের গণকবর থেকে কয়েকজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এদের বেশিরভাগই ছিল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গণমাধ্যমে চোখ রাখলে এরকম লোমহর্ষক ঘটনা প্রতিদিনই আমাদের চোখে পরে।
কিন্তু কেন ঘটছে এসব? সব দোষ কি পাচারকারীদেরই? যারা যাচ্ছে তাদের কি কোনো দায় নেই? কেবল ‘দারিদ্র’ আর ‘স্বচ্ছলতার আশা’র ওপর দায় চাপিয়ে কি পার পাওয়া যাবে?
বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, আইনের শাসন ও বিচারহীনতা মানব পাচারের জন্য দায়ী। এছাড়া রয়েছে আরো নানা সামাজিক অনুষঙ্গ।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংঘবদ্ধ দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার আশায় মানুষগুলো আশার সমুদ্রে পাড়ি জমায়। শুধু একটি চাকরি অথবা একটু উন্নত জীবনের আশায় তারা ঘর ছাড়ে আবার নতুন করে ঘরে ফিরবে বলে। কিন্তু সে ফেরা আর হয়না।
আর যারা ফিরে আসে, হারায় সবকিছু-সহায়, সম্বল, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং জীবনের মহামূল্যবান অনেকটা সময়।
মানব পাচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ দালালচক্র। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আর্ন্তজাতিক পরিসরে তারা বিস্তৃত। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে তারা গোপনে ও সংঘবদ্ধভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
যারা স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে তাদের কাজ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে লোক সংগ্রহ করা। এরাই মানব পাচারের প্রাথমিক এজেন্ট বা মাধ্যম। আবার কেউ কাজ করে শহর বা সীমান্ত এলাকায়। সীমান্ত পার হওয়ার পর কাজ করে আরেকটি গ্রুপ। এর মাঝে আরো বিভিন্ন দল বা মধ্যস্বত্বভোগী থাকতে পারে।
অধিকাংশ দালাল চক্রেরই কোনো নিবন্ধন নেই। তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রলু্ব্ধ করে। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসব দালাল।
চাকরি বা কাজের আশায় যারা বিদেশে পাড়ি জমায় তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। নেই কোনো কারিগরি দক্ষতা। অন্যকোনো কাজ করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতাও অনেকের থাকে না। আবার যেসব কাজের কথা বলে বিদেশে পাঠানো হয়, সেসব কাজেরও কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তারা কোনোভাবে বিদেশে যেতে পারলেও সেখানে গিয়ে কোনো কাজ পায় না। ফলে সব কিছু খুইয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো এ লোকগুলো সর্বস্বান্ত হয়।
জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের এক তথ্য মতে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে ২৫ হাজার লোক অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালের তুলনায় যা দ্বিগুন। পাচারকৃত এ মানব সম্পদের অর্ধেকই সমুদ্রপথে গিয়েছিল।
মানব পাচার একটি অবৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ার অংশ। এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবৈধভাবে মানুষ পাঠানোই মানব পাচার। এর সাথে অন্তত দুইটি দেশ জড়িত থাকে। একটি দেশ মানুষ পাঠায় ও আরেকটি দেশ তা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ মূলত প্রেরণকারী দেশের তালিকাভূক্ত।
বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের প্রধান গন্তব্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। এক সময়ে প্রধান গন্তব্য ছিল মধ্য প্রাচ্য। শুধু বাংলাদেশই নয়, বর্তমানে মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার জন্য সেখান থেকে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গারা সমুদ্র পথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
সময় সময় মানব পাচারকারীদের শিকার বদল হয়। কখনো শিশু, কখনো বিভিন্ন বয়সের নারী আবার কখনো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পাচারকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এক সময় উটের জকি হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশের শিশুদের ব্যবহার করা হতো। এখন কেবল শিশু নয়, সব বয়সের নারী পুরুষরাও সাগড়ে নৌকা ভাসায়। এসব নারী ও শিশুকে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগ করা হয় পতিতাবৃত্তিতে। বিক্রি করা হয় তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও। শ্রম শক্তি রপ্তানীর আদলে চলে এসব মানব পাচার।
একদিকে নতুন জীবন ও জীবিকার হাতছানি অন্যদিকে মহাসমুদ্র আর ভাসমান ছোট তরী। পেছনে তাদের পরিবার, সামনে আশার বাতিঘর। যখন ভূমিতে জল্লাদ, তখন দরিয়ায় কীসের ভয়! তাই ঝাপ দেয়া ওই মহাসমুদ্রবক্ষে। এযে বিশ্বয়কর এক সমুদ্র সঙ্গম। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি।
আইন দিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছেনা এ ট্রাজেডি।
২০১২ সালে এ লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু তাতে মানব পাচার বন্ধ হয়নি।
প্রচলিত মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় মানব পাচারের এমন ঘটনাগুলো ঘটছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
আইনে পাচারের শিকার লোকজনকে সেবা ও আশ্রয় দেওয়ার বিধান থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছেনা। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য ও সেবা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
মানব পাচারের সাথে জড়িত থাকে একাধিক রাষ্ট্র। শুরু থেকে গন্তব্য পর্যন্ত দুই বা ততোধিক দেশের পাচারচক্র এর সাথে জড়িত থাকে। কাজেই এ অপরাধ দমন করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমন্বয় ও সমঝোতা প্রয়োজন।
বছর কয়েক আগে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যে সমঝোতার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এ সমঝোতা বা চুক্তির লক্ষ্য ছিল পাচারের শিকার মানুষগুলোর জন্য মানবিক সাহায্য নিশ্চিত করা। ক্ষেত্র বিশেষে বৈধ করণ ও অবৈধ পাচার হ্রাস করণ। কিন্তু সে উদ্যোগ বেশি দূর এগোয়নি।
একটি দেশের নির্দিষ্ট আইন দিয়ে এ অপরাধ দমন সম্ভব নয়। তার বড় নজির বাংলাদেশ। এখানে মানব পাচারের সবোর্চ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও পাচার কিন্তু বন্ধ হয়নি। বরং, যে হারে মানব পাচার বাড়ছে তা যেনো ক্রমেই প্রতিরোধের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্রমেই নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে এর সাথে।
সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরেও মানব পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোর মামলা হয় অন্য আইনে। এর ফলে অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হওয়ার সুযোগ পায়। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন ট্রাইব্যুনাল (২১ ধারার ১ উপধারা) কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি। পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
একদিকে মানব পাচার বন্ধ ও অন্যদিকে নিরাপদ অভিবাসনও নিশ্চিত করতে হবে।
অভিবাসন আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে মানব পাচারের শিকার লোকদের সাহায্যের জন্য হেল্পডেস্ক করার বিধান আছে। কিন্তু এর কোনো বাস্তবায়ন আমরা লক্ষ্য করিনা। ‘জাতীয় মানব পাচার দমন সংস্থা’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করার যে বিধান আছে তার বাস্তবায়ন জরুরি।
আইনের প্রয়োগ ও সেই সাথে দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক ও আন্ত:রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও সমন্বীত উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে মানব পাচার দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৫