মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ প্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতেই।
শুধু বাংলাদেশই নয়, এ পুরস্কার বাংলাদেশের মতো আরো অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর জন্য ইঙ্গিতপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় রাষ্ট্র ও জনগণকে সম্পৃক্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার যে নজীর আমরা সৃষ্টি করেছি তা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পথ দেখাবে। পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম আরো জোড়দার করবে বলেই বিশ্ব সম্প্রদায় প্রত্যাশা করছে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও আর্থ-সামাজিক কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে জনসংখ্যার হার অধিকাংশ দেশের চেয়ে বেশি। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার চ্যালেঞ্জটাও এখানে বেশি।
অধিক জনসংখ্যা ও বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা জলবায়ু ও পরিবেশ সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলছে।
‘জলবায়ু’ কোনো আঞ্চলিক বিষয় নয়। এর প্রভাব কোনো সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে চলে না। ফলে, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার পদক্ষেপগুলোও হতে হয় বৈশ্বিক। তবে আন্ত:রাষ্ট্রীয় বা ভৌগোলিক অবস্থানভেদে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচীর আওতায়ই সাধারণত এসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এটি ‘সাধারণ ও বিশেষায়িত দায়’ বা ‘common but differentiated responsibility’-এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ পরিবেশ তথা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে এক ধরনের সাধারণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। আবার কোনো কোনো রাষ্ট্রকে বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এ বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টি নির্ভর করে ওই দেশের আর্থ-সামাজিক, শিল্প-প্রযুক্তি ও আরো নানা বিষয়ের ওপর। কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু মোকাবেলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি সাধারণ বৈশ্বিক দায়।
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোই মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ এ সমস্যা মোকাবেলা করার মতো তথ্য-প্রযুক্তি বা রসদ তার কাছে নেই। যদিও এ বিপর্যয়ের জন্য তারা দায়ী নয়। কিন্তু এর দায়ভার নিতে হচ্ছে তাদেরই। এখানেই শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ ভূমিকা। শিল্পোন্নয়ন তথা কার্বন নিঃসরণের জন্যই আজকের এ বৈশ্বিক উষ্ণতা। তাই তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য।
কাজেই উন্নত বিশ্বকে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। জলবায়ু খাতে তাদের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আশানুরূপ বিনিয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বা সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি কার্বন নি:সরণের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ ও অর্জনে উন্নত বিশ্বকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। কার্বন নি:সরণের মাত্রা হ্রাস করা না গেলে জলবায়ু মোকাবেলায় প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না। তাই সময় এসেছে উন্নত-উন্নয়ন নির্বিশেষে সমন্বীত পদক্ষেপ গ্রহণের।
কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা ব্যর্থ হলে আগামীতে এ সংকট আরো তীব্র হবে যা একসময় আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবেনা।
জলবায়ু উষ্ণতা মোকাবেলা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাই আজকের বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সাথে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও বজায় রাখতে হবে। উষ্ণতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মরুকরণ ইত্যাদির ফলে খাদ্য উৎপাদনও ব্যাহত হতে পারে। প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহার এ সংকট কিছুটা কমাতে পারলেও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান করতে পারবেনা।
রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের নিজস্ব জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা থাকা একান্ত প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জনগণের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ সমস্যা কেবল সরকার বা বেসরকারি সংস্থার পক্ষে সমাধান সম্ভব না। তবে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হয়ে সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৫