ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘রাজনৈতিক দলগুলো উশৃঙ্খল কর্মীদের পরিহার করে না’

ইলিয়াস সরকার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৬
‘রাজনৈতিক দলগুলো উশৃঙ্খল কর্মীদের পরিহার করে না’

ঢাকা: ‘আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের উশৃঙ্খল কর্মীদেরকে পরিহার করার প্রবণতা দেখা যায় না এবং অনেকাংশে তারা এদের ওপর নির্ভরশীল যা কিনা দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট অন্তরায়। সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

মুখ থুবড়ে পড়বে গণতন্ত্র’।

জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার রায়ে এমন মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

বুধবার (১৫ জুন) এ রায়ে ৬ জনের ফাঁসি বহাল, ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের লেখা এ রায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তার নিজস্ব কিছু বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণ দেন।

এ পর্যবেক্ষণে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘যে হত্যাকাণ্ডটিকে কেন্দ্র করে এই ডেথ রেফারেন্স আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, নিঃসন্দেহে এটি জঘন্যতম ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অতীতে খুব কমই সংঘটিত হয়েছে’।

‘রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ স্কুলে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহ থেকে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। আমাদের সংবিধান ও অন্যান্য আইন অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক দলে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে মানুষের চাওয়া-পাওয়া ও বিভিন্ন রকম দাবি-দাওয়া মেটানোর জন্য তথা মানুষের কল্যাণে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য’।

‘সুচারুরূপে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার থাকে সেই রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলটির সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সংসদ সদস্য বা উচ্চ পর্যায়ের নেতাদেরকে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে দেখা যায়। আবার বিপরীতভাবে এও বলা চলে, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই তাদের সমর্থন ও কর্মকাণ্ড উচ্চ পর্যায়ের নেতাদেরকে পরিচালিত করে থাকেন’ বলেও মন্তব্য করেন এই বিচারপতি।

বিচারপতি হাসান বলেন, ‘যে মামলাটির আজ রায় দেওয়া হচ্ছে, তার  উল্লেখযোগ্য অভিযুক্ত হলেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম সরকার (ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত)। এ মামলার ঘটনা থেকে দেখা যায়, নুরুল ইসলাম সরকারের সঙ্গে তখনকার সময়ের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন এবং আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহফুজুর রহমান মহলের সঙ্গে যতোটুকু ঘটনা না ছিল রাজনৈতিক বৈরিতা, তার চেয়েও বেশি ছিল অর্থনৈতিক সংঘাত। নুরুল ইসলাম সরকার স্থায়ীভাবে একজন ব্যবসায়ী, মাহফুজুর রহমান মহলও ছিলেন একজন ব্যবসায়ী’।

‘ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে দেখা যায়, উভয়ের মধ্যে স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের একটি প্রতিযোগিতা চলছিল। মহলের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও যেহেতু নুরুল ইসলাম সরকারের বিচ্ছিন্ন মাদক ব্যবসায় বাধা সৃষ্টি করেছিলেন, সেহেতু নুরুল ইসলাম সরকার ও সঙ্গীরা মহলকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনার বিষয়টি অন্যতম সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্ত মাহবুবুর রহমানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে প্রকাশিত হয়েছে যা ৩ এবং ৩৪ নম্বর সাক্ষী দ্বারা সমর্থিত’।

‘এটা পরিস্কার আমিনের (যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত) বাড়িতে যখন এই সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তরা সভাটি করছিলেন, তখনই তারা জানতেন, নিকট ভবিষ্যতে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখানে মাহফুজুর রহমান মহলসহ অনেকেই আসবেন এবং মহলকে সেখানেই হত্যা করা হবে বলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এরকম সম্মেলনে স্থানীয়  সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আরও নেতারা উপস্থিত থাকবেন এটি ষড়যন্ত্রকারীরা ভালোভাবেই জানতেন। সাধারণত এরকম একটি সমাবেশ হওয়ার আগে অন্তত বেশ কয়েকবার স্থানীয়ভাবে মাইকিং করে সভায় নেতাদের আগমনের বিষয়টি সাধারণ জনগণকে অবহিত করা হয়’।

‘প্রশ্ন হলো, এরকম জনসভায় যেখানে আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপিসহ টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাসহ শত শত আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত থাকবেন, তা জেনেও সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তরা মাহফুজুর রহমান মহলকে মারার জন্য ওই স্থানটিকেই কেন বেছে নেন? কারণ, সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের মধ্যে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি যে, এ সভায় বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলি করলে প্রচুর লোক মারা যেতে পারেন। এমনকি তারা প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত এ ঘটনার সময় কোনোরকম মুখাবরণ (মাস্ক) পর্যন্ত ব্যবহার করেননি’।

‘তখন তারা এতোটাই বেপরোয়া ছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে, তাদের চেহারা অনাবৃত থাকার কারণে কেউ যদি তাদেরকে চিনেও ফেলেন, তথাপিও তাদের কিছু হবে না। তাদের এ ধরনের ভাবনার কারণ হল, তাদের পেছনে এমন একটি শক্তি রয়েছে, যে বা যারা তাদেরকে ভবিষ্যতে সকল প্রকার সম্ভাব্য ঝামেলা থেকে রক্ষা করার শক্তি রাখেন’।

‘স্থানীয় বেপরোয়া উশৃঙ্খল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা এ ধরনের চিন্তা করতে পারেন। কারণ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের উশৃঙ্খল কর্মীদেরকে পরিহার করার প্রবণতা দেখা যায় না এবং অনেকাংশে তারা এদের ওপর নির্ভরশীল যা কিনা দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট অন্তরায়। সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। মুখ থুবড়ে পড়বে গণতন্ত্র’।

‘যে স্থানে ও যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে এ রকম হত্যাকাণ্ডকে এক কথায় বলা চলে, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বা মাস কিলিং। যেখানে কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম দ্বারা হত্যার উদ্দেশ্যে এক নিরস্ত্র বা বৃহৎ সমাবেশে আক্রমণ করা হয় এবং যেখানে অসংখ্য লোক নিহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদি সেখানেে একজন লোকও নিহত হন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে বলা যায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বা মাস কিলিং। নিঃসন্দেহে বলা যায় নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু গং এ মাস কিলিংয়ের জন্য সরাসরি দায়ী। ’

আহসান উল্লাহ মাস্টার সম্পর্কে বিচারপতি হাসান বলেন, ‘জীবনের শুরুতে ছিলেন একজন শিক্ষক পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদের একজন সদস্য হিসেবে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধাভাজন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি পালন করেছেন তার গুরু দায়িত্ব। তিনি টঙ্গী-গাজীপুর এলাকায় মাদকবিরোধী প্রচারণা এবং কার্যক্রমে ছিলেন সচেষ্ট। মাদক ব্যবসায়ী তথা সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার বিষযটি তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও বলে গেছেন বলে সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে পাওয়া যায়’।

‘আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো একজন আদর্শবান সংসদ সদস্য বেঁচে থাকলে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে তিনি আরও অনেক ভালো কাজ করতে পারতেন, যা থেকে জাতি উপকৃত হতো। সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তরা আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিকে সুযোগ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন। আজকের সমাজে আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো আদর্শবান রাজনৈতিক নেতার বড়ই অভাব’।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৪ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৬
ইএস/এএসআর

** আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার দায়ে ছয়জনের ফাঁসি বহাল
** আপিল মামলার রায় দেওয়া হচ্ছে বাংলায়
** হাইকোর্টে এমপি রাসেল, বাইরে আ’লীগের হাজারো নেতাকর্মী
** হাইকোর্টে আপিল মামলার রায় দুপুরে

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।