সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘যার পক্ষে কাজ করছি, তাকে কোনোদিন দেখিনি, চিনিও না। তারপরও বিবেকের তাড়না ও মানবিক বিবেচনায় নিজের উপার্জিত অর্থ খরচ করে জনস্বার্থের মামলা করি’।
১৯৮৮ সাল থেকে জনস্বার্থে কাজের এ সংকল্প মনজিল মোরসেদের মনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে তখন থাকতেন আজিমপুরে। সবেমাত্র ঢাকা বারে আইন পেশা শুরু করেছেন। একদিন কোর্টে থাকা অবস্থায় খবর আসে, তার একজন আত্মীয়ের সন্তান মারা গেছেন। আজিমপুরে জানাজা হবে দুপুর তিনটায়। বেলা ১২টায় খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে জজকোর্ট থেকে রওনা হয়েও জানাজায় শরিক হতে পারলেন না। কারণ, বুয়েটের সামনে রাস্তায় গরুর হাট থাকায় ব্যাপক যানজট লেগে ছিলো।
তখনই মনে হলো, যদি মামলা করে রাস্তা থেকে গরুর হাট সরানো যেতো। সেই চিন্তা বাস্তবে রূপ দিতে মনজিল মোরসেদকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ১৮ বছর। এর মধ্যে ঢাকা কোর্ট থেকে হাইকোর্টে কাজও শুরু করেছেন।
২০০৪ সালে কয়েকজন তরুণ আইনজীবী মিলে গড়ে তোলেন মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস্ ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। দুই বছর বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মধ্য দিয়ে আইনাঙ্গনে সংগঠনের পরিচিতি অর্জন করেন।
পরে ২০০৬ সালে প্রথম রিট মামলা করেন রাস্তায় বসা গরুর হাটের বিরুদ্ধে। সফল হয় তার মনে পুষে রাখা ১৯৮৮ সালের চিন্তা।
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ২০০৬ সালের পরে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়িত হওয়ায় এখন ঢাকা শহরের কোথাও রাস্তায় গরুর হাট বসে না।
পরিবেশের পাশপাশি মানবাধিকার রক্ষায়ও নেমে যান আইনজীবী মনজিল। কখনো সংগঠনের ব্যানারে, আবার কখনো ব্যক্তিগতভাবে। এভাবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক মামলা, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শহীদ মিনার সংরক্ষণ মামলায় জিতে নিজের নাম স্থান করে নেন ইতিহাসের পাতায়।
‘তবে বেশিরভাগ রিট মামলার উৎস সংবাদ মাধ্যম। সকালের পত্রিকায় যখন দেখি, কোনো জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘন, তখন খুব খারাপ লাগে। এর ওপর ভিত্তি করে পিটিশন রেডি করি। পরদিন আদালতে উপস্থাপন করি। পরে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে রক্ষা পান অধিকার লঙ্ঘিত কোনো সাধারণ মানুষ’- উল্লেখ করেন মনজিল মোরসেদ।
‘অনেকে মনে করেন, আমরা বিদেশ থেকে এনজিও হিসেবে টাকা পাই। এটি একেবারে মিথ্যা। আমি বা এইচআরপিবি পকেটের টাকা খরচ করে জনস্বার্থের মামলা করি। এটি দেশপ্রেম নিয়ে করছি’।
উল্লেখযোগ্য মামলার কথা স্মরণ করে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে আগে পুলিশ তদন্ত করতো। আমি কিন্তু প্রথম এটি ভেঙেছি। পুলিশের তদন্ত যদি পুলিশ করে তবে সত্যটা বের হবে না। এটি করবেন মন্ত্রণালয়ের অন্য কোনো কর্মকর্তা। আর এ আদেশ কিন্তু আমাদের মামলার রায়ে এসেছে’।
‘একবার মুন্সীগঞ্জের বোবা মেয়েকে ধর্ষণ করলো বখাটেরা। অভিযুক্তরা প্রভাবশালী। পত্রিকায় খবর এলো, মামলাই নেয়নি থানা। টাকা দিয়ে মীমাংসা করা হয়েছে। যেটি সম্পূর্ণ অন্যায়। তারপর জনস্বার্থের মামলা করলাম। আদালতের নির্দেশে পুলিশকে সাসপেন্ড করা হলো। হাইকোর্ট ওই মেয়েকে হাজির করে বধির স্কুলের শিক্ষকের মাধ্যমে তার বক্তব্য শুনলেন। মামলা হলো, আসামিও গ্রেফতার হলেন’।
‘নড়াইলে এক গৃহবধূকে গাছের সঙ্গে বেধে মারধরের ঘটনা পত্রিকায় আসে। কিন্তু তার স্বামী সেনা সদস্য হওয়ায় কেউ এগিয়ে আসছিলেন না এবং পুলিশ মামলাও নিচ্ছিল না। রিট মামলা করলাম। পরে আদালতের নির্দেশে মামলা নিলো পুলিশ। ওই মেয়ের স্বামীসহ কয়েকজন আটক হলেন’।
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এ রকম অসংখ্য মামলা আছে, যাদের আমি চিনি না। কিন্তু তাদের পক্ষে লড়েছি। মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করেছি’।
আইনজীবী মনজিল লড়েছেন সংবিধান ও আইন রক্ষায়ও। সরকারি কর্মচারীদের সুবিধা দিয়ে আদালত অবমাননা আইন ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইন করেছিলো সরকার। অবমাননা আইনের পুরোটাই চ্যালেঞ্জ করে এবং দুদক আইনের একটি ধারা নিয়ে রিট করেন তিনি। দু’টি বিষয়কেই অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করে দেন উচ্চ আদালত।
সর্বশেষ সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা। এতে বিচারকদের স্বাধীনতা হরণ হবে উল্লেখ করে নয় আইনজীবীর পক্ষে রিট করে দীর্ঘ আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মনজিল মোরসেদ।
এ ধরনের অন্তত ২৮০টি জনস্বার্থমূলক রিট মামলা দায়ের করেছেন তিনি, যা বিশ্বের সর্বাধিক। জীবনভর এভাবেই জনসেবা করে যাবেন বলেও মনস্থির করেছেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৩ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৭
ইএস/এএসআর
**পদকপ্রাপ্ত পরিবেশের ফেরিওয়ালা