ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

'নারী আবার বিচারক হতে পারে নাকি!'

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৭
'নারী আবার বিচারক হতে পারে নাকি!' আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা

ঢাকা: ‘আমি আত্মতৃপ্তি নিয়ে বিচারাঙ্গন থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি আমার সুদীর্ঘ বিচারক জীবনে কখনই জেনেবুঝে বা অবহেলা করে বা অমনযোগী হয়ে কোনো ভুল বা অন্যায় বিচার করিনি।’

প্রায় ৪২ বছরের বিচারক জীবনের শেষ কর্মদিবসে এসে সংবর্ধনায় বৃহস্পতিবার (০৬ জুলাই) আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এসব কথা বলেন।

দুপুরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এই নারী বিচারপতিকে বিদায় সংবর্ধনা দেয় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন।

অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের পক্ষ থেকে এই নারী বিচারপতির বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের নানা দিক তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

এরপরে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এর সভাপতি জয়নুল আবেদীনও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের ওপর আলোকপাত করেন।

এই দু’পক্ষের বক্তব্য শেষে বিচারপতি নাজমুন আরা নিজে তার ৪২ বছরের বিচারিক জীবনের নানা স্মৃতি-অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন: শেষ কর্মদিবসে দেশের প্রথম নারী বিচারপতিকে সংবর্ধনা
বক্তব্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, প্রায় ৪২ বছরের বিচারকের জীবন আমার শেষ হল আজ। বিচার করার কঠিন কাজ ও বিচারকের সীমাবদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার আগ্রহ ছিল আমার। আজকের এ ক্ষণটিতে আমার কষ্ট হচ্ছে এই বিচার অঙ্গন থেকে বিদায় নিতে, আপনাদের ছেড়ে যেতে।

‘আল্লাহ আমাকে বিচারক বানিয়েছেন, এদেশের প্রথম নারী বিচারক। তবে আমার বিচারক হওয়ার পেছনে আমার মরহুম বাবার ইচ্ছা ও মায়ের প্রেরণা বড় ভূমিকা রেখেছে। ’ 

১৯৭২ সালে আইনজীবী পেশার প্রথম দিন কোর্টের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বোধহয় আমার মনের কোণায় ইচ্ছাটা উঁকি দিয়েছিলো- আমি কি জজ হতে পারি না? কিন্তু জানলাম আমি জজ হতে পারি না। ওই সময় বাংলাদেশের নারীরা জজ হতে পারতো না। আমি ওকালতি করার বছর দেড়েক পরে ওই বিধান সরকার তুলে দেয়।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ১৯৭৫ সনের শেষের দিকে দেশের প্রথম নারী বিচারক হয়ে খুলনার জজশিপে মুনসেফ হিসেবে যোগদান করি। ওই সময়ে খবরের কাগজে এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। দু'রকমের প্রতিক্রিয়াই হয়েছিল। কেউ স্বাগত জানিয়েছিলেন, অনেকে আবার নাক সিঁটকে ছিলেন--- নারী আবার বিচারক হতে পারে নাকি, নারী আবার কি বিচার করবে!

'কর্মক্ষেত্রে আমি এই দু'রকমের আচরণ পেয়েছিলাম। প্রথম নারী বিচারক হিসেবে ব্যর্থ হয়ে যাইনি। আল্লাহর কাছে তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রথম নারী বিচারক হিসেবে আমি ব্যর্থ হলে হয়তো আজ বাংলাদেশের প্রায় ৪০০ নারী বিচারক হতো না। ’

নিজের বিচারকাজ নিয়ে প্রথম নারী বিচারপতি বলেন, আমি আত্মতৃপ্তি নিয়ে বিচারাঙ্গন থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি আমার সুদীর্ঘ বিচারক জীবনে কখনই জেনেবুঝে বা অবহেলা করে বা অমনযোগী হয়ে কোনো ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার করিনি। আমার অনেক বিচারই হয়তো ভুল হয়ে গেছে, আপিলে গিয়ে হয়তো সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু সে ভুল বিচার আমি জেনে বুঝে বা অমনোযোগী হয়ে করিনি। জেনে বুঝে অবিচার করা বা অমনোযোগী হয়ে বা অবহেলা করে ভুল বিচার করাকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে বা কোনো কারণে বা কারো দ্বারা প্রভাবান্নিত হয়ে বিচার করা মহাপাপ। আমার আত্মতৃপ্তি এই যে, আমি জেনে বুঝে বা অবহেলা করে বা অমনোযোগী হয়ে বা পক্ষাশ্রিত বা প্রভাবাান্বিত হয়ে ভুল বিচার, অন্যায় বিচার করিনি কখনোই।  

১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বিচার বিভাগে যোগদান করা এ বিচারপতির শেষ কর্মদিবস ছিল আজ বৃহস্পতিবার(০৬ জুলাই)।
 
যদিও সুপ্রিম কোর্টের পঞ্জিকামতে, তার অবসরের মেয়াদ ০৭ জুলাই। ওই দিন শুক্রবার হওয়ায় আগের দিন বৃহস্পতিবারই তার শেষ কর্মদিবস। প্রথামতে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের পক্ষ থেকে তাকে এ সংবর্ধনা দেয়।
 
পরে বিকেলে জাজেস লাউঞ্জে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা তাকে সংবর্ধনা দেবেন।
 
১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বাবা আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন ও বেগম রশীদা সুলতানা দীনের এ সন্তান ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে  এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।

পরবর্তী সময়ে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ১৯৭২ সালে এলএলবি পাস করেন। একই বছর তিনি ময়মনসিংহ জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন।

কিন্তু সেখানে থেমে থাকেননি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ (সহকারী জজ) হন। হয়ে যান ইতিহাসের অংশ। দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী বিচারক।

পরবর্তী সময়ে যোগ্যতাই তাকে ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলাজজের আসনে উন্নীত করে। আর এটাও প্রথম কোনো নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা।

তবে নিম্ন আদালতেই থেমে থাকেনি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার কর্মজীবন। ২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্টে স্থায়ী হন তিনি। হাইকোর্টেও তিনি প্রথম। সবশেষ ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ০১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের নেতৃত্বে বসান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে।
 
বিচারিক কাজের পাশাপাশি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলাতানা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের। দুই বার সেক্রেটারি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন জাজেসের। বিশ্বের ৮২টি দেশে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৫ হাজার।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪১ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৭
ইএস/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।