বাংলাদেশের নারী বিচারকের অগ্রদূত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে শনিবার (২৯ জুলাই) প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বাংলাদেশ মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশন সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে এ সম্মাননা দেয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তানজীনা ইসমাইলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকসহ নারী বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন।
গত ০৬ জুলাই অবসরে যান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ইংল্যান্ডের চেয়েও আমাদের নারী বিচারকের সংখ্যা বেশি। তাদের ওখানে নারী বিচারক ১০ শতাংশের নিচে। এখন বাংলাদেশে নারী বিচারকের সংখ্যা ৩৫ শতাংশের বেশি। ইংল্যান্ডে প্রথম নারী বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে এ বছর। আমরা পেরেছি ২০০০ সালে। বিচার বিভাগে ও আইন পেশায় আমরা পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে অগ্রগামী’।
সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের বিষয়ে তিনি বলেন,‘আমাদের মূল যে হাইকোর্ট বিল্ডিং, সেটিতে বৃষ্টির দিনে পানি চুইয়ে পড়ে একেবারে আমি যে চেয়ারে বসি, সেই চেয়ারে। আমি যে চেম্বারে বসি সে চেম্বারে পানি পড়ে। আদালতের রেকর্ড রুমে পানি পড়ে। এটির আগে থেকেই ভঙ্গুর অবস্থা। সেসব চিন্তা-ভাবনা থেকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরে আমরা সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রসারণে একটি প্রজেক্ট নেই। সেই অনুপাতে ২০ তলা বিশিষ্ট একটা প্রশাসনিক ভবনের বিষয়’।
‘আমরা যারা বিচারক আছি, তারা কিন্তু পুরনো ভবনের বারান্দায় চেম্বার করে বসি। আমাদের কোনো রুম নেই। ৪০-৪৫ জনেরও বেশি বিচারকের কোনো চেম্বার নেই। এখন তাদের বারান্দায় বসতে হচ্ছে’।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘এ বিবেচনায় আমরা একটি প্রশাসনিক ভবনের প্রস্তাব করি। অনেক চেষ্টা ভাবনা করে সেই প্রশাসনিক ভবনটি প্রি-একনেকে পাস করানোর পর একনেকে গিয়ে অজ্ঞাত কারণে এটি ফেরত পাঠানো হয়’।
‘২০০৯ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় অ্যানেক্স ভবন করার চেষ্টা করে আসছি। অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত সেটি প্রি-একনেকেই ঘুরাঘুরি করছে, আলোর মুখ দেখেনি’।
আইনমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বর্তমান যে বৃষ্টি, এবার সুপ্রিম কোর্টের যে ভঙ্গুর অবস্থা, এই অবস্থায় এই সুপ্রিম কোর্ট ভবন সর্বোচ্চ হলে ৫-৬ বছরের বেশি টিকবে না, এটি ভেঙে ফেলতে হবে। এটি যদি ভেঙে পড়ে তাহলে আমাদের কি অবস্থা হবে, সেটি বলা মুশকিল। আমাদের দু’টি রেকর্ডরুমও পুরনো ভবনে অবস্থিত। তাই আপনার (আইনমন্ত্রী) কাছে অনুরোধ করবো, আমাদের ২০তলা বিশিষ্ট প্রস্তাবিত যে প্রশাসনিক ভবন, এটাতো ফাইনাল স্টেজে। প্ল্যান-ডিজাইন সম্পূর্ণ শেষ করা, এটি ফাইনাল একনেকে পরবর্তী যেকোনো সভায় এটা পাস করান’।
সুপ্রিম কোর্টের উন্নয়ন বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি টাকাও বরাদ্দ হয়নি। যদিও এবার বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীকে আমি চিঠি দিয়ে বলেছিলাম যে, সুপ্রিম কোর্টের বরাদ্দ দরকার। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কোনো টাকা বরাদ্দ হয়নি’।
‘সুপ্রিম কোর্ট এবং অন্য খাতের বরাদ্দের তুলনামূলক পরিসংখ্যান যদি তুলে ধরি, তাহলে দেখা যাবে, এবার জাতীয় সংসদের জন্য উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হয়েছে ১৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আর আমাদের জন্য একটি টাকাও বরাদ্দ হয়নি’।
আইনমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে এ বিচার বিভাগ চলবে কিভাবে? দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, সব সেক্টরে আমরা ডেভেলপ করছি। কিন্তু বিচার বিভাগকে আস্তে আস্তে কুইজ করে একেবারে জিরোতে নেওয়া হচ্ছে। এটি জাতি ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়’।
‘আমি আশা করবো, আপনার মাধ্যমে আমি সরকারকে বলছি, এটি যদি সরকার মনে করে, প্রধান বিচারপতি রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, তাহলে আমি বলবো, হ্যাঁ, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বার্থে রাজনৈতিক বক্তব্য দেবেন। বিচারকদের অবস্থা, বিচার বিভাগের উন্নয়নে প্রধান বিচারপতি প্রয়োজনবোধে আরও বলবেন। এ বিষয়ে আমি দ্বিধান্বিত হবো না’।
বিচারক স্বল্পতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টে নারী বিচারপতি নিয়োগ দিতে অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। যদি কালকে বলেন, কালকেই আমি করতে পারি, সরকার যদি এগিয়ে আসে। আমাদের বিচারকদের স্বল্পতা অনেক। আশা করি, সরকার এটি বিবেচনা করবে’।
‘আপিল বিভাগে অন্তত তিনজন বিচারক নিয়োগে আমি সরকারকে অনুরোধ করবো’।
হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘হাইকোর্টে আমাদের একটি রেওয়াজ চলে আসছে, পলিটিক্যাল গভর্মেন্ট চলে এলে যেহেতু আমাদের কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করা নেই, ইচ্ছামতো বিচারক নিয়োগ দিয়ে দেই। এটি ঠিক নয়। আমাদের হয়তো সময় চলে আসছে- হাইকোর্টে এতোজন বিচারক থাকবেন, আপিল বিভাগে এতোজন বিচারক থাকবেন। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা যদি নির্ধারিত হয়ে যায়, তাহলে পলিটিক্যাল ইন্টারফেয়ারেন্সটা কমে যায়। বিচার বিভাগে যতো পলিটিক্যাল ইন্টারফেয়ারেন্স থাকবে না, ততোই বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গল’।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি। এ অবস্থান তৈরি করতে তাকে পার করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি। তবে সবকিছু জয় করে তিনি এখন দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসের অংশ’।
তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের মোট বিচারকের প্রায় ২৪ শতাংশই নারী। প্রতিবেশী সকল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নারী বিচারকের এ হার অনেক বেশি। এমনকি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের চেয়েও এ হার উৎসাহব্যঞ্জক। আর সেই নারী বিচারকের অগ্রদূত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা’।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৭
ইএস/এএসআর