সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন মতামত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ওই মামলায় সাত বিচারপতির মধ্যে তার রায়ের অংশে এ মতামত দেন প্রধান বিচারপতি।
তবে প্রধান বিচারপতির এ মতের সঙ্গে একমত হতে ‘অক্ষমতা’ প্রকাশ করে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘এ মামলায় এটি চ্যালেঞ্জ হয়নি এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি’।
হাইকোর্ট বিভাগ ১০৩ (২) (এ) অনুচ্ছেদ অনুসারে শুধু ১৬তম সংশোধনীর বিষয়ে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তাই ষোলতম সংশোধনীর বাইরে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রায়ে বলেছেন, ‘হাইকোর্টের সার্টিফিকেটের কারণে এখানে ওই (১১৬ অনুচ্ছেদ) ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বা অন্য ইস্যু এখানে কাভার করে না’।
১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে বিবেচনা না করার কথা রায়ে লিখেছেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীও। তিনি বলেন, ‘এখানে ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ কোনো ইস্যু নয়। এ কারণে আমি এটি বিবেচনা করবো না’।
এদিকে রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় অনুচ্ছেদ ১১৬ সম্পর্কে বলেছেন, এটি সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন, সেখানে এটি পেলাম না’।
তিনি বলেন, ‘রায়ের ভেতরে যাই বলা থাকুক না কেন, রায়ের সমাপনীতে কি বলা আছে, সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট যেটি, সেখানে কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি’।
‘আমি বলবো, এটি একজন বিচারপতির অভিমত হতে পারে। কিন্তু রায়ের শেষাংশে, যেটিকে আমরা অর্ডার অব দ্য কোর্ট বলি, সেখানে ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলা হয়নি। তাহলে ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়েছে বলে ধরা যায় না’।
মাহবুবে আলম বলেন, ‘১১৬ অনুচ্ছেদকে যদি বাতিল করতে হতো, তাহলে সবাইকে সেখানে স্বাক্ষর করতে হতো। অর্ডার অব দ্য কোর্ট তাই হতো’।
এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘১১৬ অনুচ্ছেদ তো কোনো ইস্যু ছিল না, ইস্যু ছিল ৯৬ অনুচ্ছেদ’।
ইস্যু না থাকলেও রায়ে বিষয়টি আসতে পারে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি উচিত নয়’।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে’।
রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘চতুর্থ সংশোধনীতে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্ট’ এর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতাকে হত, সঙ্কুচিত, কুঠারের নিচে (whittled down) ফেলা হয়েছে। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন ও ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দ প্রতিস্থাপন সংবিধানের পরিপন্থী’।
মঙ্গলবার (০১ আগস্ট) সকালে ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়।
গত ০৩ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলও খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।
ফলে মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আর টিকলো না। এখন আগের পদ্ধতিতে সুপ্রিম কোর্ট জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ হবে বলে জানান আইনজীবীরাও।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।
সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ০৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ০৯ নভেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
রুলের শুনানি শেষে গত বছরের ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৭
ইএস/এএসআর
** জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুন:স্থাপনে ব্যথিত অ্যাটর্নি জেনারেল
** পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়ে মন্তব্য করবেন না আইনমন্ত্রী
** ষোড়শ সংশোধনী অবৈধের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ