গত রোববার (৩০ জুলাই) প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুপুর ২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আমি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিরা আপনাদের (সরকার) সময় দেবো। বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা নিয়ে আর রশি টানাটানি নয়।
বৃহস্পতিবার নির্ধারিত সময়ের শেষ দিনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি খুবই অসুস্থ। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে জানিয়ে দিয়েছি, আজ আসতে পারছি না’।
প্রধান বিচারপতির বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর দিনই দুপুরে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রধান বিচারপতির বৈঠকের প্রস্তাবের ব্যাপারে আমি আইন মন্ত্রণালয়কে জানাবো। বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের মতামত কি সেটি জানানোর জন্য’।
পরের দিন সোমবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘তারা (বিচারপতিরা) মাসদার হোসেন মামলায় ডিসিপ্লিনারি রুলসের কথা বলেছেন। কেউ কিন্তু ডিসিপ্লিনারি রুলস করেননি। আমি আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরে এ রুলসটা করি। যেহেতু ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর ওই বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে, যেটি হাইকোর্ট, নট আপিল বিভাগ ……। তাদেরকে জানানোর জন্য এটি (রুলস) তাদের কাছে পাঠিয়ে ছিলাম’।
‘তারা সংশোধন করে যেটা দিয়েছিলেন, সেখানে দেখা গেছে, আমার কাছে ডকুমেন্ট আছে, ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা, সেটি তারা নিয়ে নিতে চান। আমি কি করে সেটি দেই?। আপনারা আমাকে রায় দিয়ে দেন, বলেন?। আমি তো দিতে পারি না’।
আনিসুল হক বলেন, ‘আমি বললাম, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আসুন, শেষ করে দেই। আমি একটি খসড়া পাঠিয়েছি। আপনারা সংশোধন করে দিয়েছেন। আমরা সেটির ওপরে সেটুকুই হাত লাগিয়েছি- যেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ ( বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে) মতে, সেটি আমি শুধু বলেছি, না, এটি দেওয়া যাবে না। ওটি ফেরত পাঠিয়েছেন’।
‘আমি তো এসে তাকে (প্রধান বিচারপতি) দিয়েছি। আমিতো এমন নয় যে, পিয়ন বা আমার সচিবকে দিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি এসে তাকে দিয়েছি। বলেছি, আপনি পড়েন, আপনি দেখেন। তার পরে যদি কোনো বক্তব্য থাকে, আমাকে জানান। তারপরেও আলোচনা করবো’।
‘তিনি এজলাসে উঠে বলেন, যে হাইকোর্টটা তাহলে উঠিয়ে দেন। হাইকোর্টতো বঙ্গবন্ধু করে দিয়ে গেছেন। আমরা কি করে উঠিয়ে দেবো? তাহলে এ কথা কি অপ্রাসঙ্গিক না? । তিনি প্রধান বিচারপতি। আমার তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান আছে। আমি সেই সম্মান ও অধিকার রেখে প্রধান বিচারপতিকে বলতে চাই, আমিতো হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট ওঠানোর কথা বলিনি’।
‘ডিসিপ্লিনারি রুলস দিয়ে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট ওঠে না। আপনার এজলাসে বসে এগুলো তো বলার তো দরকার হয় না। আলাপ-আলোচনা তো আমি করবোই। আমি কালকে যশোরে ছিলাম। তার কথা শুনে আমি ফোন করে বলেছি, আমি আসছি, বৃহস্পতিবারে বসবো। আমাদের সদিচ্ছা আছে’।
১৯৯৯ সালের ০২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেনের মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথককরণ) ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেওয়া হয়। ওই রায়ের ভিত্তিতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। আপিল বিভাগের এ নির্দেশনার পর গত বছরের ০৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।
গত বছরের ২৮ আগস্ট শুনানিকালে আপিল বিভাগ খসড়ার বিষয়ে বলেন, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিলো ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ। যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি।
এর পরই সুপ্রিম কোর্ট একটি খসড়া বিধিমালা করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। গত ১৬ জুলাই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এ সংক্রান্ত গেজেট শিগগিরই প্রস্তুত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন আইনমন্ত্রী। পরবর্তীতে ফের ২৭ জুলাই বিকেলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খসড়াটি হস্তান্তর করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
কিন্তু রোববার (৩০ জুলাই) সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির বেঞ্চ আইনমন্ত্রীর দেওয়া খসড়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হলো। তিনি খসড়া দিয়ে গেলেন। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম। যদিও খুলে দেখিনি। কিন্তু এটি কি?’
এরপর বৈঠক ডেকেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৭
ইএস/এমজেএফ/এএসআর