ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘বিডিআর বিদ্রোহ রাষ্ট্রের স্থিতি বিনষ্ট করার চক্রান্ত’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৭
‘বিডিআর বিদ্রোহ রাষ্ট্রের স্থিতি বিনষ্ট করার চক্রান্ত’ হাইকোর্ট ফাইল ছবি

ঢাকা: ৫৭জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তে লিপ্ত হয় বিপথগামী বিডিআর জওয়ানরা।

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন অভিমত তুলে ধরেছেন হাইকোর্টের একজন বিচারপতি।  

বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চ রোববার থেকে এ রায় দিচ্ছেন।

বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

এদিন সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে এজলাসে উঠে প্রথমেই বিচারপতি মো. শওকত হোসেন রায় ঘোষণা শুরু করেন। অল্প কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পরই বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। দুপুরে বিরতি দিয়ে বিকেল পর্যন্ত তিনি পর্যবেক্ষণ দেন।

দিন শেষে বিচারপতি শওকত হোসেন বলেন, সোমবার সকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করবেন। এরপরই মূল রায় (আদেশের অংশ) দেওয়া শুরু হবে।

বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণে বলেন, যুগান্তকারী এই মামলায় সাজা প্রদানে আমরা তিনজন বিচারক একমত হয়ে মামলাটি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নজীরবিহীন ঐতিহাসিক এই মামলায় পক্ষগণের যুক্তিতর্ক, আইনের ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপিত উচ্চ আদালতের নজির, মামলার প্রেক্ষাপট, পারিপাশ্বিক অবস্থা, ঘটনার গাম্বীর্য, আসামি ও সাক্ষীর সংখ্যা, তদন্ত কার্যক্রম ও তর্কিত রায়ের বিশ্লেষণসহ দণ্ড ও সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের অভিমত প্রকাশ ও সাবির্ক পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি।

আদালত বলেন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় সংগত কারণেই আইনবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, বিভিন্ন দেশে অপরাধের সাজা ও আইনের শাসন সম্পর্কে সংবিধানের নির্দেশনা বিবেচনার দাবি রাখে।

পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, এই মামলায় অভিযুক্তরা বিদ্রোহের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অমানবিক নির্যাতন, বাড়ি ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, অস্ত্রাগার ও ম্যাগাজিন ভেঙ্গে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুন্ঠন করে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়, সশস্ত্র মহড়ার মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জনজীবনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, লাশ গুম করাসহ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তসহ নানাবিধ জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে।

ঘটনার ভয়াবহতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতা, বিশৃংখলা, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্ত ও সামাজিক নিরাপত্তার দিক বিবেচনাসহ সামগ্রিক বিবেচনায় এটি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলা। এটি এদেশের ফৌজদারি অপরাধের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।

আদালত আরও বলেন, ৫৭জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে দেশের আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তে লিপ্ত হয় বিডিআর জওয়ানরা। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াসহ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহি:প্রকাশ ঘটিয়ে, নারকীয়, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে তারা। এই কলঙ্কের চিহ্ন বিডিআর (বিজিবি) জওয়ানদের বহুকাল বয়ে বেড়াতে হবে।

বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী আরও বলেন, গবেষণা থেকে পাওয়া যায় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানার হত্যাকাণ্ড একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এত অল্প সময়ে এক সঙ্গে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনা ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মোট ৫৫ জন সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন। আফ্রিকার রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর গৃহযদ্ধে ১৭ জন, দক্ষিণ ফিলিপাইনে এক বিদ্রোহে ৬ জন, ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ৭ দিনের বিদ্রোহে একশ জন নিহত হয়েছেন বলে পরিসংখ্যানে পাওয়া যায়। পিলখানার ঘটনা এসব নজিরকে হার মানিয়েছে।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা, সাহস ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্রোহ দমনের যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যা প্রশংসনীয়।   তঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ় পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। অন্যদিকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশের সার্বভৌম আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও সৃশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌ বাহিনী দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা রেখে চরম ধৈর্যের সঙ্গে উদ্ভূত ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবেলার মাধ্যমে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে দেশের মানুষের ভালোবাসা ও সুনাম অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) ২১৮ বছরের ইতিহাস, স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের (ইপিআর বাহিনী হিসাবে) অসামান্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রায়ে তুলে ধরা হয়েছে।

এর আগে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশে একটা ভয়াবহ ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ওইদিন ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এমনকি বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) মহাপরিচালকের স্ত্রীকেও হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হননি। এটা ছিল নির্বিচারে হত্যা (মাস কিলিং)। ওইদিন দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করা হয়। তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের বিচার বিভাগের জন্য এটা একটি ঐতিহাসিক মামলা। এ মামলার বিচারকালে বেশ কিছু আইনগত প্রশ্ন ওঠে। আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপতি রেফারেন্স পাঠান। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পর বিচার শুরু হয়।

তিনি বলেন, এ মামলাটি আমাদের আদালতে আসার পর ৩শ ৭০ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করেছি। শুধু মামলার ৮শ ৫০ জন আসামিই এ রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন না, দেশের অনেকেই রায় জানতে চান। কেউ কেউ নির্ঘুম রাত কাটাবেন। তাই আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। এটা অনেক বড় রায়। আমরা একটা ভাল রায় দেওয়ার চেষ্টা করছি। তাই একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের পর্যবেক্ষণ আলাদা আলাদা থাকতে পারে। তবে গন্তব্য এক। রায়ের আদেশের অংশের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। এ রায় ঘোষণার জন্য আমাদেরও রক্তচাপ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৭
ইএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।