মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার চেম্বারে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন,রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস শৃংখলাবিধি ২০১৭ প্রণয়ন করেছেন।
এই গাইড লাইন অনুযায়ী সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ মতে, জুডিশিয়াল সার্ভিস রুলস বিধিমালা প্রণয়ন হয়েছে। এর বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থাৎ অভিযোগ, অনুসন্ধান কিভাবে হবে, তারপর এটার অনুসন্ধানের পরে এদের বিরুদ্ধে, সাময়িক বরখাস্ত কিভাবে হবে। এবং এদের বিচার বা অপরাধ, অসঙ্গতির তদন্ত কিভাবে হবে সব ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে এই বিধিমালায় উল্লেখিত আছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, গেজেটে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন স্তরে পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলা আছে। এছাড়াও যদি সুপ্রিমকোর্ট মনে করে, স্বপ্রণোদিত হয়ে তারা কোনো অভিযোগের ব্যাপারে মনে করেন তদন্ত হওয়া দরকার, সেক্ষেত্রে তারাও রাষ্ট্রপতিকে জানাতে পারবেন। এবং এই পরামর্শের ধারাবাহিকতায় এ ব্যাপারেও এটা নিষ্পত্তি হবে।
‘কাজেই এটা এখন আর নিম্ন আদালতের যারা বিচারক আছেন বা যারা বিচার বিভাগীয় কার্যে নিয়োজিত আছেন তাদের শৃংখলার ব্যাপারে, তাদের অ্যাডমেনিস্ট্রেটিভ অ্যাকশনের ব্যাপারে কোনো রকম বাধা রইলো না। ’
জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের অভিযোগ ও তদন্তের ফয়সালা কিভাবে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রপতি অ্যাপয়েন্টিং অথরিটি। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন বা তিনি যদি জ্ঞাত হনে যে অসদাচরণ হচ্ছে তাহলে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এবং দণ্ড দেয়ার ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শ হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ- এটা সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে। সেটারই প্রতিফলন এই বিধিমালায় ঘটেছে।
রাষ্ট্রপতি যে কোনো পদক্ষেপই নেন না কেন সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ নিতে হবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ। এটা স্পষ্টভাবে বলা আছে, যখন কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হবে, কারো বিরুদ্ধে যদি মনে হয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার, অভিযোগ অনুসন্ধান, বিভাগীয় তদন্ত দরকার সেখানেও রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। যখন সাময়িক বরখাস্ত করা হবে তখনও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। যখন তাদের ব্যাপারে চরম পদক্ষেপ নেওয়া হবে, দণ্ড দেওয়া হবে, সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া হবে।
এই বিধি নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব ছিলো, গ্যাপ ছিলো- এটা শেষ হলো? জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী বলেছেন, কাজেই এ ব্যাপারে আমি আর কিছু বলতে চাই না। তিনি নিজেই বলেছেন কেন এতো দিন হয়নি।
এই বিধিটি হওয়ায় আপনি অনেকটা ভারমুক্ত হয়েছেন কিনা? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অবশ্যই। যেহেতু শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মাঝখানে আমাকেই অবস্থান নিতে হয়। যেটা বলে সেতুবন্ধন, ব্রিজ। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের একটি আগ্রহ ছিল, উদ্বেগ ছিলো এটা এতো দিন হচ্ছে না কেন। আর বারে বারে আমাকে সময় নিতে হয়েছে। সেটা আমার জন্য নিশ্চয় বিব্রতকর ছিল। আমার সেই বিব্রতকর অবস্থার পরিসমাপ্তি হলো।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) আদালতের কাছে একটা দরখাস্ত দিয়ে গেজেট দাখিল করবেন বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
টানাপড়েন কি নিয়ে? খসড়ার সঙ্গে গেজেটর তফাৎটা কি এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, মূল তফাতটা ছিল প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি যেটা চেয়েছিলেন, আমি যতদূর বুঝতে পেরেছি, সেটা হলো সমস্ত ক্ষমতাটা সুপ্রিম কোর্টের হাতেই থাকবে। সেটা তো সংবিধান বিরোধী একটা অবস্থান। সংবিধানে আছে রাষ্ট্রপতি করবেন, কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি যেটা চেয়েছিলেন, যে এটা সম্পূর্ণ রূপে বিচার বিভাগের হাতেই থাকবে, সেটা তো হতে পারে না ১১৬ অনুচ্ছেদ যে পর্যন্ত সংবিধানে থাকবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
‘রাষ্ট্রপতি সংসদ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, সবটারই একজন সেতু বন্ধন বলতে হবে। রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ থাকে কিন্তু রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। এ ব্যাপারগুলোকে বাদ দেয়া যাবে না। ’
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, সংবিধান হলো সবার উপরে। সংবিধান অনুযায়ী সব কিছু হতে হবে। একজন ব্যক্তির ইচ্ছাই বড় না। ব্যক্তি থাকবে না, ব্যক্তি মারা যাবে। সংবিধান থাকবে। কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন তিনি সংবিধানের চেয়ে বেশি বুঝেন, সেটা কিন্তু ভুল।
ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, প্রস্তাবনায় (গেজেট) তারা ১৩৩ অনুচ্ছেদের অধীনে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে নিয়ে গেছে এবং তাদের কর্মস্থল, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর, শৃঙ্খলা বিধান শর্তাবলী প্রণয়ন করেছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এখানে কোনো কাজ সম্পাদন করা হয়েছে বলে লেখা নেই। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদের অধীনেই রুলসটি করার কথা। অর্থাৎ সংবিধান যে ক্ষমতাটা রাষ্ট্রপতির উপর অর্পন করেছেন, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সে রুলস তৈরি করবেন। কিন্তু এখানে যেটা হচ্ছে, মন্ত্রণালয় রুলস তৈরি করার ব্যাপারে ১৩৩ অনুচ্ছেদের বরাত দিয়ে যে রেফারেন্স দিচ্ছেন, সেটা সরকারি কর্মচারিদের জন্য প্রযোজ্য। সেখানে মনে হয়, গোড়াতেই গলদ তৈরি করছে। এটার বিষয়ে নিশ্চয়ই আদালতের নোটিসে আসবে। এবং আমি মনে করি এটা সংশোধন করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রপতির ভূমিকা আইন মন্ত্রণালয় পালন করতে পারে না। অতএব রাষ্ট্রপতির সাথে সুপ্রিম কোর্টের আলোচনার বিষয়টা ১১৬ তে উল্লেখ আছে।
‘আমরা যখন সংবিধান তৈরি করেছিলাম তখন বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিষয়টাতে প্রধান্য দিয়েছিলাম এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বৈশিষ্ট অক্ষুন্ন রেখে। এজন্য অধস্তন আদালতের উপরে ১১৪, ১১৫, ১১৬ পরিচ্ছেদ আমরা দিয়েছিলাম। অধস্তন আদালত কিন্তু আমাদের সংবিধানের একটি প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বলা যেতে পারে। অতএব তাদের যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিধি-বিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেটা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং এটি মাসদার হোসেন মামলার পরিপন্থি। আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতির ভূমিকা যে দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কেবার্টের সাথে তার পরামর্শের বিষয়টা, আইনমন্ত্রীর ভূমিকা দিয়ে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা রিপ্লেস করা যায় না। ’
এক প্রশ্নের জবাবে সংবিধানের অন্যতম এই প্রণেতা বলেন, এগুলো নিশ্চয়ই সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনা হবে। আমি ইতিমধ্যেই কয়েকবার কোর্টকে বলেছি। আপনারা যে রুলস করছেন এগুলো সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ রাষ্ট্রপতির সাথে সেটার কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমি দুই/তিন দিন কোর্টকে বলেছি। ভেতরে ভেতরে কি আলোচনা হচ্ছে কেউই জানতে পারছি না। আমি উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।
প্রসঙ্গত, ১১ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা ২০১৭ এর গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
ইএস/জেডএম