তবে আদালত সরকারি কর্মকর্তাদের এমন আচরণের জন্য বলেছেন, একটি সভ্য সমাজে সরকারি কর্মকর্তার এমন কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত।
লক্ষ্মীপুরের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সালাহ উদ্দিন শরীফকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় হাইকোর্টের তলবে তৎকালীন এডিসি ও ইউএনও হাজির হওয়ার পর এমন কথা বলেছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ’র হাইকোর্ট বেঞ্চে বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন লক্ষ্মীপুরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মুর্শিদুল ইসলাম এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর উপজেলার ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) মোহাম্মদ নুরুজ্জামান।
এ সময় সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনও উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে দুইজনের আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার এবং ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন তাদের পক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এরপর আদালত রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিমের কাছে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা শোনেন। তারপর এডিসি ও ইউএনওকে ডেকে কিছু প্রশ্ন করেন। কেন সেদিন সকালে এডিসি সেখানে গিয়েছিলেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দায়িত্ব দিয়ে জেলা প্রশাসকই সেখানে পাঠিয়েছিলেন। তখন আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, এটা প্রাইমারি স্কুল। যে স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা হবে। আর সেই পরীক্ষায় নকল ধরতে একজন এডিসিকে পাঠানো হয়েছে কি চমৎকার!
এরপর ইউএনওকে আদালত বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। কে তাকে সেখানে খবর দিয়ে নিয়েছে, সেসব বিষয়ে। এছাড়াও সাবেক সিভিল সার্জন কোনো অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা যেতো বলে মন্তব্য করেন আদালত।
পরে আদালত ডা. সালাহ উদ্দিনকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, আপনি রিটায়ার্ড পারসন। বয়স হয়েছে। এতো উত্তেজিত হন কেন। ওনারা তো আপনার ছোট। আপনারা উচ্চ শিক্ষিত মানুষরা যদি হাতাহাতি করেন, এ সমাজে লজ্জা কার? ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না বলে আশা করি।
পরে এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে দু’জনকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দেন আদালত।
এ সময় আদালত বলেন, হাতাহাতির পর সাজা দেওয়ার ঘটনাটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রকৃষ্ট উদহারণ। একটি সভ্য সমাজে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত।
আদালত বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অতীব প্রয়োজন। কিন্তু এর অপব্যবহার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আদালত আশা করে প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় দায়িত্বরতরা মোবাইল কোর্ট আইন অনুযায়ী পালন করবেন।
আদালত আরও বলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের ভবিষ্যতে এমন কোনো পর্যায়ে নিয়োগ দেওয়া না হয়, যেন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারেন।
গত সোমবার (০৪ ডিসেম্বর) সকাল ৯টার দিকে শহরের জেলা প্রশাসকের বাসভবন এলাকার কাকলি শিশু অঙ্গনের (বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) প্রবেশমুখে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মুর্শিদুল ইসলাম ও সাবেক সিভিল সার্জন শরীফের মধ্যে বাকবিতণ্ডার পর হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
পরে পুলিশ দিয়ে আটক করে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সালাহ উদ্দিন শরীফকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পুলিশ তাকে কারাগারে পাঠায়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আদালত পরিচালনা করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নুরুজ্জামান।
একদিন পর মঙ্গলবার বেলা ১১টায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আপিলের পর বিচারক মীর শওকত হোসেন পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় ওই চিকিৎসকের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে চিকিৎসকের কারাদণ্ডের বিষয়ে দুই আইনজীবী রিট করেন। ওই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এডিসি শেখ মুর্শিদুল ইসলাম ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরজ্জামানকে ১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় হাইকোর্টে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ হাজির থাকতে তলব করেন। সালাহ উদ্দিন শরীফকেও উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
অন্যদিকে ঘটনার পরদিন এডিসি শেখ মুর্শিদুল ইসলামকে ওএসডি করা হয়েছে। এক প্রজ্ঞাপনে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে পদায়ন করা হয়।
এছাড়া ০৬ ডিসেম্বর বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত লক্ষ্মীপুরের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সালাহ উদ্দিন শরীফ আপিলে বেকসুর খালাস পান।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৭
ইএস/জেডএস