শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজীব ও দিয়া খানমের মৃত্যুর ঘটনায় জাবালে নূর পরিবহনের চালক ও তার সহকারীদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ে আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।
মামলায় দুই চালকসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ।
রায় ঘিরে সকালেই আসামিদের আদালতে আনা হয়। এ সময় তাদের মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এরপর বিকেল তিনটার দিকে চার আসামিকে আদালতে তোলা হয়। এর কিছুক্ষণ পর বিচারক রায় ঘোষণা শুরু করেন। প্রথমে মামলার বিচার কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন বিচারক। মামলায় ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দেন ৩৭ জন। যার মধ্যে রয়েছেন মামলার বাদী দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম, রাজীবের মামা, দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা।
বিচারক বলেন, এই মামলায় জাবালে নূর পরিবহনের মালিক শাহাদাত হোসেনের মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিত রয়েছে। আসামিদের মধ্যে কাজী আসাদ পলাতক রয়েছেন। বাকি চার আসামির মধ্যে তিনজন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এসব জবানবন্দিতে উঠে আসে জাবালে নূরের তিনটি বাস একসঙ্গে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যার মধ্যে একটি বাস পেছনে পড়ে। অপর দুই বাসের চালক জুবায়ের সুমন ও মাসুম বিল্লাহ ঘটনাস্থল জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের উপরে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে। এক পর্যায়ে জুবায়ের সুমন ডান দিক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়ায়। মাসুম বিল্লাহ ডান দিকে ঢুকতে না পেরে অধিক যাত্রী তোলার আশায় বাঁ দিক দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের উপর বাসটি তুলে দেয়। ফলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন দুই শিক্ষার্থী। যার মধ্যে ঘটনাস্থলেই রাজীবের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়।
আদালত বলেন, যেহেতু এই দুই চালক ওই রাস্তায় নিয়মিত গাড়ি চালাতো তাই তারা জানতো যে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার থেকে নামার ঢালটি বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখান থেকে নামতে গিয়ে মাসুম বিল্লাহর গাড়িটি ফ্লাইওভারের পাশে রেলিংয়ে দুবার ধাক্কা লাগে। ওই গাড়ির হেলপার এনায়েত ও গাড়ির যাত্রীরা বারবার মাসুম বিল্লাহকে সাবধান করে দেয় এবং ধীরে গাড়ি চালাতে অনুরোধ করে। কিন্তু বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও সে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিহত দুই শিক্ষার্থীসহ অন্য শিক্ষার্থীদের উপর তুলে দেয়। যারা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তারা চিকিৎসা নেয়।
বিচারক বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩০৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে ঘটনা ঘটার পর ২৭৯ ধারায় আর শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। আসামি জুবায়ের সুমনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে মাসুম বিল্লাহ রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের উপর তুলে দেয়। ৩০৪ ধারা অনুযায়ী হত্যা নয়, কিন্তু অপরাধজনক প্রাণনাশের মতো জখমের উদ্দেশ্য থাকতে হবে। রাজীবের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়া সেরকম জখমেরই প্রমাণ। তাই দুই চালক মাসুম বিল্লাহ, জুবায়ের সুমন ও তার গাড়ির হেলপার আসাদ কাজীকে এই ধারার অধীনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
বিচারক এনায়েত হোসেনের খালাসের কারণ উল্লেখ করে বলেন, মাসুম বিল্লাহ তার স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, গাড়ির হেলপার এনায়েত এখানে কোনো অপরাধ করেন নাই। বরং তিনি তার চালককে সতর্ক করেছিলেন। তাই তাকে খালাস দেওয়া হলে।
তবে মামলার অপর আসামি জাবালে নূরের মালিক জাহাঙ্গীর আলম ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও হালকা গাড়ির লাইসেন্সধারী চালককে ভারী যান চালাতে দিয়ে অপরাধ করেছেন বলে বিচারক উল্লেখ করেন। এরপরও তাকে খালাস দেওয়া হয়। বিচারক রায়ে ভারী যানবাহনের লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও জাবালে নূরের মতো বড় বাস চালানোর অনুমতি দিয়ে অন্যায় করেছিলেন, বিচারক তার পাঠ করা রায়ে এর ব্যাখ্যা দেননি।
দণ্ডের ঘোষণার পর বিচারক কিছু পর্যবেক্ষণ দেন। যেখানে তিনি বলেন, জাবালে নূর পরিবহন সেক্টরের ড্রাইভার, হেলপারদের খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতায় কী ছাত্রছাত্রী, কী যুবক, কী বয়স্ক ব্যক্তি, কেউই বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে জীবন বিনষ্ট হওয়া থেকে রেহাই পায় না। বর্তমান মামলায় রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই জন মেধাবী উদীয়মান ছাত্রছাত্রী নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। সেদিন দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজীবের ঘনিষ্ঠরা, আত্মীয় স্বজনসহ সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে আসে।
তিনি বলেন, গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপারের খামখেয়ালিপনায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় দায়ীদের বিচার চাইতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ফলে পরিবহন সেক্টরের অধিক ভাড়া উপার্জনের জন্য মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে ভারী যান চালানোর লাইসেন্স বিআরটিএ কর্তৃক অনুমোদন না করা সত্ত্বেও ভারী গাড়ি চালিয়ে যত্রতত্র মানুষের উপর তুলে দিয়ে হত্যা করে চলছে। এ যেন দেশের পরিবহন সেক্টরের ড্রাইভার হেলপারদের খামখেয়ালিপনায় মানুষ হত্যার নেশায় পরিণত হয়েছে। যা বন্ধ হওয়া আবশ্যক।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, তাছাড়া অধিক টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে গাড়ির মালিক অধিক জমা বেঁধে দেওয়ার ফলে ড্রাইভার হেলপার দ্রুতগতিতে বিভিন্ন বাস স্টপেজে যাওয়ার জন্য অবৈধ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। যার ফলে প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনাসহ জীবনহানি ঘটে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিবহন মালিকের অধিক টাকা উপার্জনের মানসিকতা পরিহার করা যেমন আবশ্যক তেমনি রাস্তায় নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সদস্যরা নিয়মিত ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করলে হালকা লাইসেন্স দিয়ে ভারী যান চালানোর সুযোগ পাওয়া যেতো না। মালিকপক্ষ হালকা যানবাহন চালকদের কম বেতন দিয়ে ভারী যান চালানোর কাজে নিয়োজিত করেন। ফলে ড্রাইভাররা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ভারী গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এক্ষেত্রে মালিকদের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চালকদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
এক পর্যায়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনেরও প্রশংসা করেন আদালত। পর্যবেক্ষণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তার মতো ইতিবাচক ভূমিকা রাখার আহ্বানও জানান বিচারক।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, সংবাদ এমনভাবে প্রচার করবেন না যাতে ছাত্রসমাজ বা সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় বা মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়। এই মামলায় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় আসামিদের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এই ধারার সর্বোচ্চ শাস্তিই যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সেটি আগে উল্লেখ করার অনুরোধ করছি। তাই এই ধারায় এর চেয়ে বেশি দণ্ড দেওয়ার সুযোগ ছিল না।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৯
কেআই/জেডএস