ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

পি কে হালদার: অর্থ ফেরত পেতে হাইকোর্টে ৪ আমানতকারীর আকুতি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০২১
পি কে হালদার: অর্থ ফেরত পেতে হাইকোর্টে ৪ আমানতকারীর আকুতি পি কে হালদার

ঢাকা: আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে জমা রাখা টাকা ফেরত পেতে হাইকোর্টে আকুতি জানিয়েছে আমানতকারীরা। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতির পরিবার, সাবেক রাষ্ট্রদূত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন।

প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) গ্রেফতারের বিষয়ে চলা এক সুয়োমোটে মামলার শুনাতিতে তারা এ আরজি জানান।

রোববার (৩ জানুয়ারি) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের বক্তব্য লিখিত আকারে জমা দিতে বলেন।

আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিনউদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহজাবিন রাব্বানী দীপা ও আন্না খানম কলি। পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ও এক পরিচালকের পক্ষে ছিলেন মো. মোশাররফ হোসেন।

১৮ নভেম্বর দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর তাকে বিদেশ থেকে ফেরাতে এবং গ্রেফতার করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে স্বপ্রণোদিত আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

ওই আদেশ অনুসারে দুদক ২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক। এরপর ৯ ডিসেম্বর পিকে হালদারের কাজিন পিপলস লিজিংয়ের সাবেক পরিচালক অমিতাভ অধিকারী এবং পিকে হালদারের সাবেক সহকর্মী ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দীকে আবেদনের প্রেক্ষিতে এ মামলায় পক্ষভুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে পিকে হালদারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইন্টারপোলের কাছে পাঠানো এবং তার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে ৩ জানুয়ারি পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট।

ধার্য তারিখ অনুসারে মামলাটির শুনানি শুরু হলে দুদক আইনজীবী আদালতের কাছে এসব আমানতকারীর কথা তুলে ধরেন এবং তারা আদালতের সামনে কথা বলার অনুমতি চান। এরপর অনুমতি নিয়ে ভার্চ্যুয়ালি সংযুক্ত হয়ে টাকা ফেরতের আকুতি জানান, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে ড.নাশিদ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকতুর রহমান,আমানতকারী সামিয়া বিনতে মাহবুব ও খালেদ মনসুর ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা। এ সময় আমানতকারী সাবেক একজন রাষ্ট্রদূতও উপস্থিত ছিলেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে ড. নাশিদ কামালের মেয়ে বলেন, এখানে আমার, আমার চাচা মোস্তফা জামান আব্বাসী ও ফুফু-ফুফার টাকা রয়েছে। কোম্পানির এই অবস্থা শোনার পর তিনি প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্না দিয়েছি। কোনো ফল পাইনি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত হওয়ার পরও আমরা টাকা রাখার যদি কোন আস্থা না পাই তাহলে এ দেশের উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের অগ্রগতি কীভাবে থাকবে? এখানে যদি নিরাপদ না থাকে তাহলে আর কাকে বিশ্বাস করব?

সামিয়া বিনতে মাহবুব বলেন, আমি একজন গৃহিণী। আমি ক্যান্সারের রোগী। আমি ২০১৭ সালের প্রথম দিকে পিপল লিজিং এ টাকা রেখেছিলাম। যেটা কিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত, নিবন্ধিত। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ার মাার্কেটে অন্তর্ভুক্ত। এতো সব বিশ্বাস নিয়ে আমরা সেখানে টাকা রেখেছি, আমি এবং আমার স্বামী মিলে সারা জীবনের অর্থ জমা করে এক কোটি টাকা রেখেছি।

এর মধ্যে আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। এরপর থেকে আমি চাকরি করছি না। করোনার মধ্যে আমার স্বামীরও চাকরি নাই। এখন কোনো আয় নেই। এখন আমরা নিদারুণ দিন যাপন করছি। চরম অর্থ সংকটে জীবন যাপন করছি। টাকার জন্য সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছি না। গত ১ বছর বাচ্চাদের একটু মাছ-মাংস খাওয়াতে পারিনি। সব মিলিয়ে আমরা মানসিক কষ্টে আছি। এখানে যারা ডিপোজিটররা আছে তাদের কাছ থেকে হাত পেতে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত লিজিংয়ে টাকা রাখার পরও আমি আজকে চিকিৎসার অভাবে দিন কাটছে, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন সামিয়া বিনতে মাহবুব।

তিনি বলেন, বাস্তব পরিণতি কী হবে এটা না বুঝেই এ প্রতিষ্ঠানে আমরা টাকা রেখেছিলাম। কিন্তু পিকে হালদার গং এভাবে টাকা নিয়ে যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? আমরা যারা টাকা জমাকারিরা সরল বিশ্বাসে টাকা রেখেছি। আমরা কেন এতো কষ্ট পাবো। আমরা তো এই দেশের নাগরিক। আমাদের জন্য কী কারো কিছু করার নাই। আমরা কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছি, আমাদেরকে বাঁচান।

খালেদ মনসুর ট্রাস্ট্রের হিসাব শাখার কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, এই ট্রাস্ট দেশের বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত। বিভিন্ন শিক্ষার্থীদেরও বৃত্তি প্রদান করা হয়। দুস্থ ও গরিবদের মাঝে বিনিয়োগের লভ্যাংশ বিতরণ করে থাকে। আজকে তাদের সেই টাকাও আর উঠাতে পারেন নাই। গরিব অসহায় মানুষের এই টাকা হটকারিরা হস্তগত করেছে।

মো. শওকতুর রহমান বলেন, সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকা, সন্তানের লেখাপড়া, বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার জন্য এই টাকা রেখেছিলাম। টাকা রাখার পরে তারা নানা ভাবে আমাকে হয়রানি করলো, ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে আমাদের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিল। এ টাকা আদৌ পাবো কিনা সেই চিন্তা নিয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছি। দেশটা কি স্বাধীন করেছিলাম এভাবে নিজে প্রতারিত হওয়ার জন্য? আমার কোন দাবি নাই, আমি শুধু আমার টাকা ফেরত চাই। আর কিছু নয়।

এসব বক্তব্যকে আদালত বেদনাদায়ক বলে উল্লেখ করে লিখিত আকারে দিতে বলেন।

পরে খুরশীদ আলম খান বলেন, একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছিলেন আদালত। সেটা আজকে দাখিল করেছি। পিকে হালদারের বিষয়ে এই সুযোমোটো রুল জারির পরে চারজন ভিকটিম আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। তারা আদালতে কথা বলার সুযোগ চান। সে অনুযায়ী এসেছেন। আমি আদালতে বলেছি। আদালত তাদের কথা শুনেছেন। তাদের কথাগুলো লিখিত আকারে দাখিল করতে বলেছেন। মামলাটি মঙ্গলবার আবার কার্যতালিকায় আসবে।

তিনি বলেন, দুদক পিকে হালদারের ঠিকানা ও তার ভাইয়ের ঠিকানা পেয়েছেন। এগুলো আদালতে দাখিল করেছেন। ইন্টারপোলের কাছে সব কিছু দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি সব প্রক্রিয়া শেষ। এখন যে কোনো সময় রেড অ্যালার্ট জারি হবে।

প্রশান্ত কুমার হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরে দুই বিনিয়োগকারীর করা আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ১৯ জানুয়ারি এক আদেশে প্রশান্ত কুমার হালদারসহ সংশ্লিষ্ট ২০ জনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

এর মধ্যে দেশে ফিরতে প্রশান্ত কুমার হালদার এ বিষয়ে আদালতের কাছে আবেদন করতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের কাছে একটি পত্র দেন। এরপর কোম্পানিটি আদালতে আবেদন করে। ৭ সেপ্টেম্বর আদালত বলেছেন তিনি কখন কীভাবে আসবেন তা জানাতে। পরে ২০ অক্টোবর একটি আবেদন করেছে কোম্পানিটি। যেখানে নির্বিঘ্নে দেশে আসার কথা বলা হয়েছে এবং সেখানে ২৫ অক্টোবরের একটি টিকিটের কপিও সংযুক্ত করা হয়।

২১ অক্টোবর হাইকোর্ট এ বিষয়ে এই আদেশ দেন। আদেশে দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার গ্রেফতার নিশ্চিত করতে বলা হয়। পরে তার গ্রেফতারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠাতে বলা হয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক, ইমিগ্রেশন অথরিটির চিফ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কিন্তু ২৪ অক্টোবর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের আইনজীবী দুর্নীতি দমন কমিশন এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে জানান, পি কে হালদার ২৫ অক্টোবর দেশে ফিরছেন না।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০২১
ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।