ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

লন্ডন

আলেক্সিসের নতুন সরকার

আশায় বুক বেঁধেছে গ্রিসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫
আশায় বুক বেঁধেছে গ্রিসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

এথেন্স, গ্রিস থেকে: আলেক্সিস সিপ্রাসের (Alexis Tsipras) নেতৃত্বাধীন বামপন্থি জোট ‘সিরিজা’র (SYRIZA) ক্ষমতায়নে ঋণভারে জর্জরিত গ্রিক নাগরিকদের মত নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন সেদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। একই আশাবাদ বাংলাদেশ হাইকমিশনেরও।

মঙ্গল ও বুধবার ভিন্ন ভিন্ন আলোচনায় বাংলানিউজের কাছে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এথেন্সে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও বাংলাদেশ হাইকমিশন।

হাইকমিশনের হিসেব মতে গ্রিসে বৈধভাবে বসবাস করছেন এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা  ২০ হাজারের উপরে হলেও স্থানীয় কমিউনিটি নেতাদের মতে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩০ হাজারের কাছাকাছি।

গত বছরের ২৫ জানুয়ারি গ্রিক পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করে বিশ্বরাজনীতিতে চমক সৃষ্টি করে আলেক্সিস সিপ্রাসের বামপন্থি রাজনৈতিক জোট 'সিরিজা'। সবচেয়ে বেশি ঋণভারে জর্জরিত ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যভূক্ত এই দেশটিতে কে আসছেন ক্ষমতায় এনিয়ে ইইউ নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ছিল ব্যাপক কৌতূহল। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তরুণ বামপন্থি নেতা আলেক্সিস সিপ্রাস নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনলে গ্রিসের ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচনী প্রচারণায় গ্রিসের ঋণভারে জর্জরিত জনগণকে ঋনমুক্ত করার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আলেক্সিস, সেই স্বপ্ন কতটুকু তিনি বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন? সঙ্গে আরো গুটিকয় প্রশ্ন: ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রিকস'-এর মত কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত কোয়ালিশন সরকার দিয়ে অভিবাসী কমিউনিটিকে গ্রিসের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে তার সিরিজা জোটের পলিসিই বা কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন তিনি?

বাংলাদেশিসহ অভিবাসী কমিউনিটিতে এমন আলোচনা সমালোচনা চললেও আলেক্সিসের মত ক্যারিসম্যাটিক নেতা তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেনই---- এমন আশাবাদ অন্যদের মত বাংলাদেশিদেরও। নির্বাচনী প্রচারণায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকাংশই সমর্থন দিয়েছিলেন আলেক্সিসের 'সিরিজা' কোয়ালিশনকে। অন্যান্য অভিবাসী কমিউনিটিরও অভিন্ন অবস্থান ছিল। আলেক্সিসের ক্যারিসম্যাটিক বক্তৃতা আকৃষ্ট করেছিল তাদের। অভিবাসী কমিউনিটিকে গ্রিসের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে ঋণভারে জর্জরিত দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোকাবেলায় তাদের সহযোগী করার কথা বলেছিলেন তিনি। 'সিরিজা'র পলিসিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদেরই শুধু মুলধারায়  সম্পৃক্ত করার কথা বলা হলেও আলেক্সিসের এই মন্তব্য অবৈধদের বৈধতা দেয়াসহ অভিবাসী কমিউনিটির সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ইঙ্গিত বলেই ধরে নিয়েছেন সবাই। ৩শ আসনের পার্লামেন্টে ১৪৯ আসন নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর আলেক্সিস সরকার গঠনের লক্ষে ইমিগ্র্যান্টবিরোধী চরম ডানপন্থী দল ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রিকস'র সাথে কোয়ালিশন করেছেন। তথাপি অভিবাসীরা তাদের  আশাবাদ ত্যাগ করেননি।

দীর্ঘ ৬ মাস পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ থেকে গ্রিসে আসা উল্লসিত বাংলাদেশি অভিবাসী রুকন মন্ডল। নির্বাচনে আলেক্সিসের জয়ের পর মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর কাছে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন: 'আশা করছি এবার গ্রিস পাসপোর্টের অধিকারী হবো, এবং এই পাসপোর্ট ফ্রান্স,স্পেন, জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের দরজাও আমার জন্য খুলে দেবে'। বাংলানিউজের কাছে  একই আশাবাদই ব্যক্ত করলেন গ্রিসে বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যতম নেতা আলীম খালাসি ও জাকির হোসেন।

গ্রিস আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আলিম খালাসি ও গ্রিস জিয়া পরিষদের সভাপতি জাকির হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও নিজ  কমিউনিটির সুখময় ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর এই দুই কমিউনিটি নেতা একই টেবিলে বসে একই সুরে গ্রিসের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিসের উপর তাদের আস্থা ও ভরসার কথা জানালেন বাংলানিউজকে।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অবৈধ অভিবাসীদের আপন করে নিজ বুকে টেনে নিতে পারেন একমাত্র আলেক্সিসের মত নেতাই, বাংলানিউজের কাছে এমন আশাবাদ  গ্রিসে বাংলাদেশি কমিউনিটির সহ-সভাপতি ফারুক মিয়ারও। বাংলাদেশ হাইকমিশনও ইমিগ্রেশন স্টেটাস নিয়ে সমস্যায় পড়া অন্য বাংলাদেশিদের বিষয়ে  আলেক্সিস সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক ভূমিকাই আশা করছেন।

হাইকমিশনারের পার্সোনাল অফিসার সোহেল রানা বাংলানিউজকে বলেন, সিরিজা জোটের বিজয়ে ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটিতে ব্যাপক আশাবাদ আমরাও লক্ষ্য করেছি। আশা করছি, এই আশাবাদের মূল্যায়ন করবে নতুন সরকার। বাংলাদেশিদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ে দূতাবাস সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে জানিয়ে সোহেল রানা বলেন, 'অবৈধ বাংলাদেশিদের বিষয়ে কন্স্যুলার সেকশন থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে গ্রিস কর্তৃপক্ষের সাথে, ডিটেনশন সেন্টারগুলোর সাথেও রয়েছে যোগাযোগ'। তবে স্থানীয় ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে আটক বাংলাদেশিদের সংখ্যা জানাতে পারেননি এই হাইকমিশন কর্মকর্তা। সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন 'আমি নতুন জয়েন করেছি, এবিষয়ে কিছু জানি না'। তিনি এই প্রতিবেদকের ফোন নম্বর রেখে দিয়ে পরে এবিষয়ক বিস্তারিত তথ্য জানাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

গ্রিসের নতুন সরকারকে ঘিরে দেশটির জনগণ ও অভিবাসী কমিউনিটিতে যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে আলেক্সিস সিপ্রাসের সরকার? এনিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে অবশ্য রয়েছে ব্যাপক সংশয়। মূল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঋণ পরাশোধে ইইউ'র সাথে সমঝোতাই বা কতটুকু করতে পারবেন তিনি? এনিয়ে এখনও পরিষ্কার কোনো ধারণা এখনও দিতে পারছেন না আলেক্সিস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাজার হাজার গ্রিক নাগরিক হত্যা ও ১৯৪২সালে তাঁর দেশ থেকে জোড়পূর্বক ঋণ নেয়ার অভিযোগ তুলে সম্প্রতি ইইউ তহবিলের সর্বোচ্চ যোগানদাতা জার্মানির প্রতি আলেক্সিস দাবি জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ঐ অনাদায়ী ঋণের বর্তমান মূল্য ১১ বিলিয়ন (১ হাজার ১শ কোটি) ডলার গ্রিসের কাছে পাওনা ইইউ'র ঋণ খাতে পরিশোধ করা হোক।

গ্রিসের তরুণ প্রধানমন্ত্রীর ঐ দাবি অবশ্য সাথে সাথেই নাকচ করে দিয়েছে জার্মানি। জার্মান ভাইস চ্যান্সেলর সিগমার গাব্রিয়েল (Sigmar Gabriel) বলেছেন আজ থেকে ২৫ বছর আগে জার্মান-গ্রিস চুক্তির মাধ্যমে সমাধানকৃত ইস্যু নতুন করে উত্থাপন করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।   একদিকে ঋণমুক্তির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, অন্যদিকে ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার কারণে ইইউ সদস্যপদ হারানো ---এই দুই কঠিন কঠিন সমস্যার চোখ রাঙানি এখন গ্রিসের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসের সামনে। ইইউ'র ঋণ নিয়ে সদস্য দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলেক্স কোন সমঝোতায় যে যান সেটাই এখন দেখার বিষয়।

অন্যদিকে ইমিগ্র্যান্টবিরোধী কট্টর ডানপন্থী সংগঠন ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রিকসকে সঙ্গে নিয়ে দলের নীতি দ্বিতীয় প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের কিভাবে মূলধারায় স্বাগত জানাবেন আলেক্সিস, এটি নিয়েও তাঁর সামনে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোকাবেলার সংগ্রামে ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটিকে সঙ্গে নেয়ার তাঁর ঘোষণা গ্রিক নাগরিকরা কতটুকু সহজভাবে নেবেন এটি নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। কারণ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত গ্রিসের জন্য ইমিগ্রান্ট কমিউনিটির বোঝা গ্রহণ কতটুকু যৌক্তিক এনিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে গ্রিক সমাজে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এমন আশঙ্কাই করছেন।

উল্লেখ্য, ২৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আন্তোনিস সামারাসের (Antonis Samaras) নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন নিউ ডেমোক্রেসি পার্টিকে হারিয়ে বিজয়ী হয় আলেক্সিস সিপ্রাসের বামপন্থি রাজনৈতিক জোট 'সিরিজা'। ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে সিরিজা' পায় ১৪৯ আসন। বিগত পার্লামেন্টে সিপ্রাসের নিজের দল আসন পেয়েছিল ৭১টি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিস সামারাসের নেতৃত্বাধীন নিউ ডেমোক্রেসি পার্টি পায় ৭৬ আসন, বিগত পার্লামেন্টে দলটির আসন সংখ্যা ছিল ১২৭টি।

বাংলাদেশ সময়: ০৩২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ