ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লন্ডন

অ্যাডভেঞ্চার আমাজন-১

পৃথিবীর ফুসফুসে এক স্রোতে দুই নদী, পানির রং ভিন্ন

সৈয়দ আনাস পাশা, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৫
পৃথিবীর ফুসফুসে এক স্রোতে দুই নদী, পানির রং ভিন্ন ছবি: মাহাথির পাশা ও নাহিয়ান পাশা/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আমাজন জঙ্গল, ব্রাজিল থেকে: বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট আমাজনকে বলা হয় ‘দ্যা লাঙ অব ওয়ার্ল্ড বা পৃথিবীর ফুসফুস। বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেনের প্রয়োজন তা তৈরি করে বৃক্ষরাজি।

যত বেশি সবুজ বৃক্ষ তত বেশি অক্সিজেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এ রেইনফরেস্ট অক্সিজেন সরবরাহের অন্যতম উৎস। বেঁচে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ উপাদান বেশি পরিমাণ সরবরাহ করায় আমাজনকে ডাকা হয় পৃথিবীর ফুসফুস নামে।

১৯ থেকে ২২ ডিসেম্বর, চারদিনের আমাজন অভিযানে জানা যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ জঙ্গল সম্পর্কে বিচিত্র সব তথ্য। গভীর জঙ্গলে ঢুকে বৃক্ষরাজির সঙ্গে পরিচয়, আমাজন নদী ভ্রমণ, ডলফিনের সঙ্গে সাঁতার, জঙ্গল মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ, নদীর সংযোগে দুই রঙের পানি, ভয়ঙ্কর অজগর, কুমির ছানা ও আমাজন এনিমেল স্লথের সঙ্গে আড্ডা- এসব ছিলো অভিযানের অংশ।

এতে আরও আছে পশুপাখি ও মাছ বিষয়ক গবেষক, ব্রাজিলের বিশিষ্ট মেরিন বায়োলজিস্ট মারকো জে লিমা’র সঙ্গে কথোপকোথন, যিনি অভিযানের পুরো সময়ই প্রতিবেদক ও অভিযাত্রী গ্রুপের সঙ্গে ছিলেন। রেইনফরেস্ট অভিযানে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পাশাপাশি মারকোর সাক্ষাৎকারেও আমাজন সম্পর্কে জানা যায় বিচিত্র সব তথ্য। তিন পর্বের ধারাবাহিকে থাকবে সেসব কথা।

প্রথমে জেনে নেওয়া যাক ‍আমাজন সম্পর্কে। ৫.৫ মিলিয়ন স্কয়ার মিটার বা ২১ লাখ ২৩ হাজার ৫শ ৬২ স্কয়ার মাইল এরিয়ার আমাজন রেইনফরেস্টের অধিকাংশই ব্রাজিলের অংশ, যা মোট এরিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ। বাকি অংশের মধ্যে পেরু ১৩ ও কলম্বিয়া ১০ শতাংশ।

অবশিষ্ট ১৭ শতাংশ রেইনফরেস্ট এলাকা বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলা, গায়ানা, ফেঞ্চ গায়ানা, সুরিনেইম ও ইকুয়েডরের মালিকানাধীন। স্পেনের মতো ১২টি দেশের আয়তন মিলে যতটুকু হয়, আমাজনের মোট আয়তন ততটুকু।

এই রেইনফরেস্টে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ৪০ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ চিহ্নিত হলেও ব্রাজিলের বিশিষ্ট মেরিন বায়োলজিস্ট মারকো জুশেফ লিমার মতে, আমাজনে আছে ২ মিলিয়নেরও বেশি জাতের বৃক্ষ।

বিজ্ঞানীদের মতে ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতীর কীটপতঙ্গ, ১৩শ প্রজাতির পাখি, ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব, ৪২৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী ও ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপের বসবাস আমাজনে।

বিশ্বের সব প্রজাতির পাখির প্রতি পাঁচটির একটি বসবাস করে এ বনভূমিতে। আমাজনের শুধু ব্রাজিল অংশেই বসবাস করে ৯৭ হাজার থেকে ১ লাখ ২৯ হাজার সাপজাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ রেইনফরেস্টের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে আমাজন ও রিও নিগ্র নদী। এই নদীর পানি প্রবাহে বিচরণ করে প্রায় ২ হাজার ২শ প্রজাতির মাছ। বিশ্বের সব প্রজাতির মাছের প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটি বিচরণ করে এই রেইনফরেস্ট থেকে প্রবাহিত আমাজন নদীতে।

বনাঞ্চলে কীভাবে জন্ম নেয় নতুন নতুন বৃক্ষ? এ বিষয়ে বলতে গিয়ে মারকো জে লিমা জানান, বন্যার সময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন গাছের ফল তাদের খাবার হিসেবে সংগ্রহ করে। এই খাবার একসঙ্গে না খেয়ে তারা ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে খাবার লুকিয়ে রাখার অনেক স্থান হারিয়ে ফেলে। ফলে হারিয়ে যাওয়া স্থানে থেকে ফলগুলো পচে সেখানেই বীজ পড়ে। এই বীজ থেকে হয় নতুন গাছ।

ফল খাওয়ার পর এর বর্জ্য মাছ মুখে করে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেললে এর থেকেও জন্ম নেয় নতুন নতুন গাছ। মাছ ছাড়া জঙ্গলের জীব-জন্তুও নতুন গাছ সৃষ্টিতে রাখে ভূমিকা। বনের ফলমূল খেয়ে পশুপাখিরা বিভিন্ন স্থানে মলমূত্র ত্যাগ ও ফলমূলের বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বর্জ্য ও মলমূত্র থেকেও জন্ম নেয় নতুন নতুন গাছ। এভাবেই প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় নতুন গাছগাছালি, যা টিকিয়ে রাখে জঙ্গলের অস্তিত্ব, বাঁচিয়ে রাখে পরিবেশ।

রেইনফরেস্ট ঘেঁষে প্রবাহিত দুই নদীর একটি আমাজন ও অন্যটি রিও নিগ্র। দুই নদীর সংযোগস্থলে প্রবাহিত হয় দুই রঙের পানি। এই দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন দুই নদীর সংযোগস্থলে উপস্থিত হন বিপুল সংখ্যক পর্যটক।

রিও নিগ্র নদীর পানি কালো আর আমাজনের পানির রং মাটির মতো। মেরিন বায়োলজিস্ট মার্কোর মতে, নদীর তলদেশের ধরন ছাড়াও অন্য আরও অনেক কারণে দুই নদীতে দুই রঙের পানি হতে পারে। প্রচণ্ড গরমে বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে বিধৌত হয় বনাঞ্চল। সব ময়লা আবর্জনা, জীব জন্তু ও তার দেহবাশেষ, গাছপালা ধুয়ে নিয়ে এই পানি এসে পড়ে নদীতে।

গরম পানিতে চায়ের পোটলা ফেললে যেভাবে রং বেরোয়, ঠিক তেমনি বনাঞ্চলের মাটি ও গাছপালা বৃষ্টি বিধৌত হয়ে ঠিক সেই রঙের পানি হয়ে এসে পড়ে নদীতে। বনাঞ্চলের সব স্থানে একই জাতের গাছপালা বা মাটি নেই বলে দুই নদীর এই দুই রঙের পানি।

আমাজন নদীর দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৪শ ৩৭ কিলোমিটার। এই নদীতে প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহিত হয় ২ লাখ ৯ হাজার মিটার কিউব। ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও পেরুর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত এই নদী পানি প্রবাহের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী। অন্য নদী রিও নিগ্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় কালো পানি প্রবাহের নদী। ২ হাজার ২শ ৩০ কিলোমিটার লম্বা এ নদীর উৎসম‍ুখ আমাজন নদী। ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ নদীতে প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ হয় ২৮ হাজার মিটার কিউভ।

আগামী পর্বে থাকছে: জাগুয়ার, বিষাক্ত সাপ, ডলফিনের গল্প।



বাংলাদেশ সময়: ০৮২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৫
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ