ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লন্ডন

স্টুটগার্ডের চিঠি

নিয়ম ও শিষ্টতার দেশ জার্মানি 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৭
নিয়ম ও শিষ্টতার দেশ জার্মানি  বার্লিন প্রাচীর জার্মান জাতিকে বিভক্ত ও পশ্চাৎপদ করে রাখতে পারেনি। ফাইল ফটো

অনেস্টি ইজ দ্যা বেস্ট পলিসি, বহুল ব্যবহৃত কথাটির মর্মার্থ শতভাগ না হলেও নিরানব্বই ভাগই কাজে লাগিয়েছে জার্মান জাতি। এ কারণেই এরা আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পেরেছে। আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতায় বিষয়টি আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি।

পবিত্র ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্রই হলো, সততা, সত্যবাদিতা, মানবতা আর নিয়মানুবর্তিতা। ইসলামের এ মূলমন্ত্র আমরা মুসলিম জাতি পুরোপুরি গ্রহণ ও চর্চা করতে না পারলেও তা কাজে লাগিয়েছে জার্মানিরা।

জার্মানির শিশু থেকে নব্বই বছর বয়সী প্রতিটি মানুষ ওই মূলমন্ত্রে জন্ম নিয়ে সে অনুযায়ী জীবনধারণ ও কাজ করে মৃত্য পর্যন্ত। সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবখানে যেন সততা আর মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করার প্রতিযোগিতা চলছে।

আমার বড় ছেলেকে নিয়ে যখন জার্মানিতে এলাম, চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি সব দেখেশুনে সে তার ছোট্ট সরল মন থেকে নিজেই বলতো, এটা একটা নিয়ম ও সিস্টেমের দেশ। প্রথম প্রথম ভেবে অবাক হতাম, এতটা নিখুঁত টাইম মেইনটেইন করে এরা চলে কিভাবে! কিন্তু এখন আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বাস, ট্রেন ইত্যাদি যতো যানবাহন আছে, বড় কোনো সমস্যা না হলে এক চুলও সময়ের এদিক ওদিক করে না। সময়ের হেরফের তো হয়ই না।

আরও যেটা লক্ষ্যণীয় তা হলো গাম্ভীর্য ও সুশান্ত পরিবেশ বজায় রাখা। এরা কখনও শব্দ দূষণ বা অহেতুক হট্টগোল ও অসভ্যতা করে না। পথেঘাটে বাস, গাড়ি ইত্যাদি কোনোও যানবাহনেরই হর্ণ শুনতে পাওয়া যাবে না। যানবাহন, পথচারি সব যেন ট্রাফিক সিগন্যাল অনুযায়ী যার যার নিয়ম ও গতিতে নীরবে চলছে। যানবাহনের গতিবিধিও বেঁধে দেওয়া গতিতেই চলে। তাই দুর্ঘটনাও তেমন নেই বললেই চলে।

বড় রাস্তাঘাট তো বটেই, আবাসিক এলাকাগুলোতেও কোনো অতিরিক্ত শব্দ শুনতে পারবে না কেউ। আবাসিক এলাকাগুলোতে একেবারে নিয়ম করে দেওয়া আছে। বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা, আর রাত ১০টার পরে প্রতিবেশী বা অন্যের অসুবিধা হয় এমন কোনোও শব্দ করা যাবে না এবং কেউ তা করেও না। কেননা আইনের ব্যবস্থা কঠিন। আর প্রতিবেশী বিরক্ত হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারে বিধায় সবাই সেভাবে অভ্যস্ত। আমাদের দেশের মতো নানা কারণে উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে জনগণের অসুবিধা এদেশে কল্পনাও করা যায় না।

জার্মানি থেকে আমি ইতালি বেড়াতে গিয়ে দেখেছি, ইতালিয়ানরা কিছুটা বাংলাদেশিদের মতো শব্দপ্রিয়। সেখানে বাড়িতে বাড়িতে উচ্চস্বরে মিউজিক বাজাতে শুনেছি। কিন্তু জার্মানিতে এক বাড়ির শব্দ অন্য প্রতিবেশী কেউ শুনতেই পারে না। জার্মানরা প্রয়োজনের বেশি যেমন কথা বলে না, আবার কথায় কথায় ‘দাংকে/বিটে’ (থ্যাংকস/ওয়েলকাম) দিতেও ভুলে যায় না। ভদ্রতা, শিষ্টতা, নম্রতার দৃষ্টান্ত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সবাই সেগুলো চমৎকারভাবে মেনে চলে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে দু’টি বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ শোনা যায়, তা জার্মানিতে নেই। জার্মানের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট আর ডাক্তার সমাজ সততা ও মানবিকতাবোধে মনে হয় পৃথিবীতে দৃষ্টান্তমূলক। পুরো দেশটাই একেবারে পুলিশ কন্ট্রোল। অথচ এদেশের পুলিশ কাউকে ধরে ধরে পিটায়ও না, কাউকে গালমন্দও করে না। অথচ কেউ অন্যায় করার আগে অন্তত দশবার পুলিশের কথা চিন্তা করে।

জার্মানির ডাক্তারদের উদারতা তুলনাহীন। ডাক্তারদের ব্যবহার, কথা, চিকিৎসার ধরণ সম্পর্কে হাজার কথা বললেও শেষ হবে না। এদেশের ডাক্তাররা রোগীদের রোগ নিরাময় করতে জীবনবাজি রাখে। এমনই নিবেদিতপ্রাণ তারা। সেবার ব্রত নিয়েই তারা চিকিৎসার দায়িত্ব সর্বাত্মকভাবে পালন করেন।

জার্মান জাতি অত্যন্ত সত্যবাদী। নিজেরাও মিথ্যা কম বলে এবং কেউ মিথ্যা বললে তা সহ্যও করে কম। কোনো অন্যায়কারী অনেক সময় সত্য বলার কারণে তার অন্যায়ের শাস্তি কিছুটা লাঘব করতে পারে। আবার মিথ্যার আশ্রয় নিলে তা অনেক বেড়েও যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায়-ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশ আবার বিশ্বসেরা হয়েছে অনেকগুলো অনুপম গুণে। জার্মানদের সততা, সত্যবাদিতা, নিয়মানুবর্তিতা আর মানবতার শিক্ষা তাদেরকে আলোকিত ও সমৃদ্ধ করেছে। আর তাই মাঝে মাঝে ভাবি, উন্নত-মানবিক গুণাবলি অর্জন করে আমরা কবে আমাদের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো!

কনা ইসলাম, জার্মান প্রবাসী লেখক ও সংগীতশিল্পী।

বাংলাদেশ সময়: ০১০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৭
এমপি/এইচএমএস/জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ