ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

নৌকায় পাচার

নারী-শিশুর পরিণতি ধর্ষণজনিত মৃত্যু

বাংলানিউজ ইনভেস্টিগেটিভ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২২ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৫
নারী-শিশুর পরিণতি ধর্ষণজনিত মৃত্যু ছবি: প্রতীকী

কুয়ালালামপুর (মালয়েশিয়া) থেকে ফিরে: নৌকায় পাচার হওয়া নারী-শিশু নৌকাতেই উপুর্যপরি ধর্ষণের শিকার হয়। কেউ কেউ এমন পাশবিকতা সহ্য করতে না পেরে সাগরেই  ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।

আর যারা বেঁচে থাকে, তারা মুখোমুখি হয় ভয়ংকর ভবিষ্যতের।

আর ধর্ষণে কোন নারীর গর্ভে সন্তান এলে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই সেই শিশুও বিক্রি হয়ে যায় চড়ামূল্যে।
 
শুধু নারী ও কন্যাশিশু নয়, ধর্ষণের শিকার হয় ছেলে শিশুরাও। ছেলে শিশুকে ‘দ্বিগুণ মুনাফা’র আধার ভাবা হয়। কারণ যৌনকর্মী বা শ্রমিক হিসেবে তাদের ব্যবহার করা তো যায়ই, প্রয়োজনে অঙ্গ খুলেও বিক্রির সুযোগ থাকে। এসব বিচারে নারী শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর বাজারদর অনেক ক্ষেত্রেই বেশি থাকে।  
 
সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
 
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ক্যারাম এশিয়ার রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর হারুন আল রশিদ। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে নিজের ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি পাচার হওয়া নারী-শিশুদের পরিণতির কথা জানান।
 
হারুন বলেন, একবার যে নারী পাচার হয়ে নৌকায় উঠেছে, তার অজান্তেই জীবন পুরোটাই বদলে গেছে। বাকি জীবনটা ধর্ষণের শিকার হতে হয় নানাভাবে। এক সময় অকাল মৃত্যু হয় তাদের। শিশুদের জীবনও তাই। কোন স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ তারা কখনোই পায় না। তিলে তিলে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যায়।
 
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে আর্ন্তজাতিক সংস্থা তেনাগানিতা। পাচার হওয়া নারী-শিশুদের ভয়ংকর ঘটনাগুলো তাদের নথিভর্তি।
 
সংস্থার সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক প্রোগ্রাম অফিসার আশিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, নৌকায় দিনে অন্তত তিন থেকে চারবার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন পাচার হওয়া নারীরা। কেউ কেউ মারা গেছেন নৌকাতেই। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের যে নারীরা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বেঁচে এসেছেন, তাদের বেশিরভাগের পেশা হয়েছে যৌনকর্ম। যারা বাসাবাড়িতে কাজ পেয়েছেন, তারাও শিকার হন ধর্ষণের।
 
তিনি বলেন, আমরা যাদের পেয়েছি, তাদের কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। বিভিন্ন পতিতালয়ে নারীদের বিক্রি করা হয়। যৌনকর্মী হিসেবে বিকৃত রুচির মানুষের চাহিদা মেটাতে বাধ্য হন তারা।

আশিক বলেন, পাচার হয়ে আসা কন্যাশিশুদের ১০/১২ বছর পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয় এসব কাজের জন্য। যৌনকাজে বয়স যখন ৩০ পার হয়, তখন বাজারে চাহিদা কমতে থাকে।  
 
‘এরপর তাদের সন্তানধারণে বাধ্য করা হয়। এতদিনের পাশবিক অত্যাচার ও বাধ্যতামূলক সন্তানদান- সব মিলিয়ে তাদের শরীর ভেঙে পড়ে। শরীরে বাসা করে যৌনরোগসহ হৃদপিণ্ড ও অবসাদজনিত রোগ। এভাবে ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ কারণেই পতিতালয়ে বয়ষ্ক নারী আর দেখা যায় না। ’

আশিক বলেন, তাদের রেখে যাওয়া সন্তানদের জীবনও আবর্তিত হয় অস্বাভাবিক নিষ্ঠুরতায়। একের পর এক বিক্রি হতে থাকে তারা।

সীমান্ত এলাকা থেকে নৌকায় পাচার হয়েছিলেন আয়েশা (ছদ্মনাম)। এখন তিনি মালয়েশিয়ায় যৌনকর্মী। বাংলানিউজের সরাসরি আলাপ হয় না তার সঙ্গে। তার পরিচিত মাহবুবের (ছদ্মনাম) কাছে আয়েশার জীবনবৃত্তান্ত জানা যায়।

পূর্ণ নাম-পরিচয় না প্রকাশের শর্তে মাহবুব বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিরাতে আয়েশা বিক্রি হয়। কিন্তু টাকা তার হাতে আসে না, যায় মালিকের হাতে।   

টেকনাফ থেকে যাত্রা শুরু হওয়া নৌকাটিতে আয়েশাসহ মোট ৩০০ জন যাত্রী ছিল। তার মধ্যে ৬০ জন নারী, ২০ জন শিশু। আয়েশা কেবল ১৫ বছরের কিশোরী তখন। সঙ্গের আরও দু’জন কমবয়সী কিশোরীর পাশবিক অত্যাচারে মানসিক ভারসাম্য হারায়।

বঙ্গোপসাগরের মাঝে নৌকা ৩২ থেকে ৪০ ঘণ্টা থাকার কথা থাকলেও তাদের নৌকাটি ছিল ৭২ ঘণ্টা। ১২ জন ট্রাফিকের হাতে ছিল বন্দুক ও বেত। দিনে এক পোয়া পানি ও এক প্যাকেট ম্যাগি নুডলস খেতে দেওয়া হত বন্দিদের।

তাদের মধ্যে ৬/৭ জন পুরুষ বন্দি রোগভোগে মারা যান, দুইজনকে পিটিয়ে মারে পাচারকারীরা, একজনকে গুলিতে।

মেরে ফেলার কারণ হিসেবে আশিক বলেন, ভয় দেখাতে ও খাদ্য-সঙ্কট কাটাতে এভাবে মেরে ফেলা হয়েছে তাদের।

আশিক ও মাহবুবের বর্ণনায় জানা যায়, থাইল্যান্ডে আসার পর পুরুষ ও নারীদের আলাদা করা হয়। নারীদের ঠিকানা হয় বিভিন্ন পতিতালয়ে। যৌনদাসীর জীবন-যাপনের এক পর্যায়ে অকাল মৃত্যুতে ঢলে পড়েন তারা- যা আদতে ধর্ষণজনিত মৃত্যু, হত্যা।

তেনেগানিতার ‘অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং ইন পার্সন্স’ সেল-এর পরিচালক ও পরামর্শক এজেল ফার্নান্দেজ এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, সবাইকে সচেতন হতে হবে। ব্যক্তি, সরকার- কেউই এর বাইরে নয়।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পাচারকারীরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিপ্রাপ্ত। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের প্রভাবশালী কেউ এতে জড়িত থাকে। তাই সরকার চাইলেও মানবপাচারের বিষয়টি সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু এক্ষেত্রে কঠোর না হয়ে উপায় নেই। কারণ সরকারের দায়িত্বই এখানে সবচে’ বেশি।  

বাংলাদেশ সময়: ১১০৭ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৫
এমএন/এসকেএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ