ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৬
লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মধু চাষে বিশেষ পারদর্শী এরা। কিন্তু বাঁশের ছোট ছোট টুকরায় ভরা মধুপাত্রের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রুঙ্গুস তরুণীইবা মধুর চেয়ে কম কিসে? ঠোঁটে তার ভুবনভুলানো হাসি। চোখে কৌতুহলী অভ্যর্থনা।

মারি মারি (ইনানাম) থেকে: মধু চাষে বিশেষ পারদর্শী এরা। কিন্তু বাঁশের ছোট ছোট টুকরায় ভরা মধুপাত্রের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রুঙ্গুস তরুণীইবা মধুর চেয়ে কম কিসে? ঠোঁটে তার ভুবনভুলানো হাসি।

চোখে কৌতুহলী অভ্যর্থনা।

লাস্যময়ীর পরনের কালো পোশাকটাতে জপমালার দাপুটে উপস্থিতি। শরীর জুড়ে পিতলের চাতকি। ঘাড়ে, হাতে, পায়ে চাতকির অলংকার। কোমরে পিতলের রিং। বুকে আর ঘাড়ে পেঁচানো কার্তুজের পেটির মতো অদ্ভূত এক বেল্ট। শরীর জুড়ে আরো কতো কিছু যে জড়ানো তার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা মুশকিল।

পোশাকে যে এরা বোর্নিওর আর সব আদিবাসী গোষ্ঠীর চেয়ে আলাদা তা এই মেয়ের পরিধেয়ই বলে দিচ্ছে। আগ্রহ ভরে বুঝিয়ে দিলো কি করে বাঁশের চোঙ্গা পাতা হয় মৌমাছির জন্য। তার ভেতরে কি করে বাসা বেঁধে মধু জমায় মৌমাছি। একটা বাঁশের ভেতরে চাক গড়ার প্রক্রিয়া শুরুর পর সাত মাসের বাঁশচক্রই তো জলের মতো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলো সে।

তারপর হাসিমুখে বাড়িয়ে দিলো ছোট্ট এক বাঁশের পাত্র। তাতে তাদেরই তৈরি বিশেষ মধু। আশপাশে মৌমাছি উড়ছে। তাদের বঞ্চিত করে মধুটুকু গলাধঃকরণ করে মনে হলো, মধুতে এতো স্বাদ কি করে হয়?

লঙহাউজরুঙ্গুস সুন্দরীকে বাই বাই দিয়ে আর একটু সামনে বাড়তেই লঙহাউজ। বোর্নিও দ্বীপে যে ক’টা আদিবাসী গোষ্ঠী লঙহাউস বানায় এরা তাদের অন্যতম।

কয়েক ফুট উঁচু বাঁশের প্লাটফর্মের ওপর গড়া লঙহাউজটায় বাঁশের পাটাতনে গাছের গুঁড়ির থামে বাঁশের বেড়া। উপরে পাতার ছাউনি। একপাশে সারি সারি ঘর। বিশাল হল ঘরের ভেতরে প্রতিটি পরিবারের আলাদা আলাদা বসত ইউনিট ধরতে হবে এগুলোকে। এক পাশে থাকে সামাজিক বিচার-আচার আর আড্ডার ঝুল বারান্দা। দেয়ালগুলো বাইরের দিকে ঢালু। এক সময় ৭৫ দরোজার লঙহাউজ বানাতো এরা। এক ছাদের নিচে বাস করতো ৫০ থেকে ৮০ পরিবার। মানে গোটা গ্রাম।

হাতের বাঁয়ের ছোট্ট ঘরটায় সবজি, খাবারের রসদ। নাম না জানা অনেক সবজিলতার পাশে বিশাল আকারের ঝিঙা, লাউ, লাল মরিচ, ঢেঁড়শ, এমনকি সুপারিও দেখা গেলো। একপাশে বাঁশের ডালায় গোল গোল করে কাটা মিষ্টি ভূট্টা। অপূর্ব স্বাদ তার।

ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে সাজিয়ে রাখা খলুইগুলো বুঝিয়ে দিলো কৃষি কাজের পাশাপাশি মাছ ধরতেও ওস্তাদ রুঙ্গুসরা। এরা খাওয়ার জন্য ধান চাষ করে। বিক্রির জন্য বোনে নারিকেল আর কলা গাছ। মেয়েরা কাপড় বোনো তাঁতে। তৈরি করে আঙুরলতার পাত্র।


এরা ভাত খায় সবুজ সবজি আর মাছ দিয়ে। মরিচ দিয়ে খায় বেগুন। অসাধারণ লেবুর সরবত তৈরি হয় রুঙ্গুস লঙহাইজে।  

এই লঙহাউজটার সামনের হলঘর মতো জায়গাটায় বসে বাঁশের ছিলকা ঘষে বাঁশের ভেতরই আগুন জ্বালছে এক রুঙ্গুস তরুণ।

বাঁশের সরু একটা ফোঁকরের ভেতর বাঁশের ছিলকা ভরে বাঁশ ঘষতে ঘষতে চোখের সামনেই কয়েক পলকে কেমন আগুন জ্বলে উঠলো। পুরোটাই যেনো যাদু। কিন্তু চোখের ধোঁয়া, পরে আগুনের ছোট্ট কুণ্ডলীটাকে জ্বলতে দেখে চোখের ভেলকি ভাবার কোনো সুযোগ কিন্তু রইলো না।  

এরা মূলত কাদাজান-দুসুন গোষ্ঠীরই উপগোষ্ঠী। একসময় আকি বাগাঙ নামে এক অরণ্যমানব বাস করতো বোর্নিও দ্বীপের ১৩ হাজার ফুঁট উঁচু মাউন্ট কিনাবালুর সর্বোচ্চ শিখরে। তার ছেলে টমবুরুঙ্গুস এর নামেই এই রুঙ্গুস নাম। তবে এদের আছে নিজস্ব ভাষা, পোশাক, স্থাপত্য রীতি, সামাজিক আচার। মৌখিক সাহিত্য ছড়িয়ে আছে এদের সমাজের পরতে পরতে।

ধর্মীয় রীতিতে এরা ছিলো সর্বপ্রাণবাদী। কিন্তু ধর্মান্তরিত হয়ে এখন খ্রিস্টান হয়ে গেছে প্রায় সবাই। এদেরই একজন এখানকার চৌকস গাইড বেন।

সদ্য হাস্যময় বেনের শরীরে দু’টো সবুজ গিরগিটি খেলে বেড়াচ্ছে। কি এক অদ্ভূত কায়দায় ও দু’টোকে পোষ মানিয়েছে এই রুঙ্গুস তরুণ। একটার নাম সে রেখেছে শ্যারন, আর একটার নাম টমাস।

ওদের সঙ্গে তো দেখি তোমার দারুণ বন্ধুত্ব মন্তব্য করতেই দু’কান ছুঁয়ে গেলো বেনের হাঁসি। বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললো, ওরা ভেজিটেরিয়ান। খুব শান্ত। সব সময় আমারই শরীরেই খেলে বেড়ায়।  

আরও পড়ুন

**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ

** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে


বাংলাদেশ সময়: ১০০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৬
জেডএস/জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ