ঢাকা: রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ ও যানজট কমাতে উদ্বোধন হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল। কিন্তু যানজটের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিললেও ফুটপাতে স্বস্তিতে চলাচল করতে না পারায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন যাত্রীরা।
উত্তরার দিয়াবাড়ী ও আগারগাঁও স্টেশনের মাঝে বর্তমানে চলাচল করছে মেট্রোরেল।
কী সমস্যা মেট্রোরেল স্টেশনের ফুটপাতে
উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত স্টেশন সংখ্যা ৯টি। স্টেশনগুলো হলো-উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও।
বর্তমানে দিয়াবাড়ী ও আগারগাঁও স্টেশন চালু রয়েছে। এজন্য সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত প্রচণ্ড ভিড় থাকে এ দুটো স্টেশনে। এরই মধ্যে দুইটি স্টেশন মিরপুর-১০ ও শেওড়াপাড়া স্টেশনে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। অন্যদিকে আগারগাঁও স্টেশনের ফুটপাত বেদখল হয়ে রয়েছে।
কিন্তু আগারগাঁও স্টেশন থেকে পাসপোর্ট অফিসমুখী রাস্তার ফুটপাতে চলছে দখলদারিত্ব। ভ্রাম্যমাণ চা দোকানি, কম্পিউটার নিয়েও অনেকে বসে পড়েছেন পাসপোর্ট অফিসগামীদের সেবা দেওয়ার উদ্দেশে।
এ নিয়ে আগারগাঁও স্টেশনে আসা যাত্রী শাহেদ রায়হান বলেন, যাত্রীদের হাঁটতে প্রচণ্ড সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় ফুটপাতে দোকানপাট থাকায়। প্রশাসনের এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
এদিকে মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ স্টেশনে ফুটপাতে খুঁড়াখুঁড়ির কাজ যেন সারাবছরই লেগে থাকে। শুধুমাত্র পথচারীদের চলাচলেই সমস্যা নয় না, ফুটপাতের পাশের অনেক দোকানিকে ব্যবসায় বন্ধ করতে হয়েছে।
এ এলাকায় দীর্ঘদিন বসবাস করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আশিক কুণ্ডু। তিনি বলেন, বাস কিংবা মেট্রোরেল থেকে হেঁটে যে বাসা বা কাজের জায়গায় পৌঁছাবেন সে অবস্থা নেই।
অন্যদিকে শ্যাওড়াপাড়া স্টেশনের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়ায় এখনও অপ্রস্তুত এ স্টেশন। এরফলে এখানে শুধু পথচারি নয় ক্ষতির মুখে আছেন ব্যবসায়ীরাও।
শ্যাওড়াপাড়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় কাপড়ের দোকান ব্যবসায়ী শরিয়ত হোসেনের। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের কাজ শুরুর পরে আমার দোকানের সামনের ফুটপাতে যে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে সেটা এখন শেষ হয়নি। আশপাশের অনেকে দোকান বিক্রি করে দিয়েছে লোকসানের কারণে।
আমিও লোকসানে আছি, আগের চেয়ে চার ভাগের এক ভাগ ব্যবসাও হয় না। তারপরও লোকসান গুনে ব্যবসা চালাচ্ছি মেট্রোরেল চললে ব্যবসা ঠিক হবে কিন্তু এখনও ঠিক হওয়ার লক্ষ্মণ নেই।
শ্যাওড়াপাড়া এলাকায় বসবাস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী মাসুম হোসেন। তিনি বলেন, ৬ বছর ধরে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। অথচ এখনও সম্পন্ন হয়নি স্টেশনের ফুটপাতের কাজ। ফুটপাত ঠিক না থাকলে মানুষ চলাচল করবে কিভাবে মেট্রোরেলে। এসব আগেই ঠিক করা দরকার ছিল।
শেওড়াপাড়াবাসী শরিফুল ইসলাম বলেন, কাজীপাড়ার মতো আমাদের শেওড়াপাড়া স্টেশনের ফুটপাত সরু হলেও উদ্বোধন করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এটার কাজ শেষ হওয়ার কথা হলেও হয়নি।
এ প্রসঙ্গে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মেট্রোরেলকে পূর্ণাঙ্গভাবে সক্ষমতা দিতে হলে যাত্রীর জন্যে ফুটপাত প্রশস্ত করতে হবে। যাত্রীরা যেন ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারে, স্টেশনে নেমে গণপরিবহন পায় এবং সহজে গণপরিবহনে আসতে পারে তবেই মেট্রোরেল ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, স্টেশনের ফুটপাত প্রস্তুত না হয়েই অপারেশন শুরু হওয়ায় কয়েক মাস কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া স্টেশনের যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়বেন।
এ স্টেশন দুটির সমস্যা হওয়ার পেছনের কারণ সম্পর্কে এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, মূলত জমি অধিগ্রহণে দেরি হওয়ায় কাজ শুরু হতে দেরি হয়েছে স্টেশন দুটির।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ
এমআরটি লাইন-৬-এর উপ-প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী (ডিপিএম) মাহফুজুর রহমান বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের মধ্যে শেওড়াপাড়া আর কাজীপাড়ার কিছু কাজ এখনও চলছে। উঠানামার সিঁড়ির কাজ ও ড্রেনের কাজ চলছে।
স্টেশন সংলগ্ন ফুটপাত প্রস্তুত না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শ্যাওড়াপাড়া স্টেশনের ফুটপাতের কাজ শেষ হতে দেরি হবে। এখন বলা যাচ্ছে না, কিছুদিন পরে সঠিক সময় বলতে পারবো কবে নাগাদ ফুটপাত প্রস্তুত হবে।
গত বছরের (২০২২) ২০ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম মিরপুর-১০, আগারগাঁও, শ্যাওড়াপাড়া স্টেশনে ফুটপাত সমস্যা নিয়ে পরিদর্শনে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সে সময় তিনি বলেন, উত্তর সিটির আঞ্চলিক এ কার্যালয়ের জায়গা সরকারের সিস্টেম অনুযায়ী অধিগ্রহণ করে, আমরা চাচ্ছি এখানে ৪ থেকে ৫ তলা বিশিষ্ট আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং করতে। আর এর উপরে থাকবে পাবলিক ওপেন স্পেস। এতে করে যে কেউ তার মোটরসাইকেল বা গাড়ি এখানে পার্কিং করে তাদের মেট্রোরেলে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারবে। আমরা যদি লাইন পরিবর্তন করে অন্যদিকে যেতে চাই তাহলেও এ স্টেশনে এসে পরিবর্তন করতে। এটি একটি জংশন হিসেবে কাজ করবে।
যারা মেট্রো ৫ বা ৬ এ যাবে তাদের জন্য মিরপুর-১০ মেট্রোস্টেশন একটি মিলনমেলার স্থলে পরিণত হবে বলেও মন্তব্য করেন উত্তরের মেয়র।
মেট্রোরেলের শুরুর যাত্রা
উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটারের মেট্রোরেলের রুটটির নাম এমআরটি লাইন-৬। এ রুটটিতে ৪০ মিনিটেরও কম সময়ে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ২৪ জুন মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। প্রথমে এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। পরে মতিঝিল থেকে কমলাপুর বাড়তি অংশ যোগ হওয়ায় ১১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয় বেড়ে সর্বমোট খরচ দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগী জাইকা করছে ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। আর সরকারি অর্থায়ন ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়, ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ পর্যায়ক্রমে তিন ধাপে শেষ করা হবে।
এমআরটি লাইন-৬ বাদে অন্য প্রকল্পের অগ্রগতিও হচ্ছে সময়মতো। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২৮ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন রুটের নির্মাণকাজ শেষ করা হবে।
তৃতীয় পর্যায়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৫: সাউদার্ন রুট, এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪ ও এমআরটি লাইন-১ এর নির্মাণকাজ শেষ করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০২৩
এনবি/জেএইচ