ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক, অভিযোগ অনেক

ডালিম হাজারী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক, অভিযোগ অনেক

ফেনী: দাগনভূঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের হাসান গণি পুর গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অরফ্যান্স সেন্টার স্কুল। ২০০২ সালে গ্রামের বাসিন্দা ও শিক্ষানুরাগী মোহাম্মদ নূর ও তার পরিবারবর্গের সহায়তায় এটি নির্মিত হয়।

কথিত আছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্কুলটি এ অঞ্চলের জনগণের শিশু, এতিম ও দুস্থ:দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছে। কিন্তু এখন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠাটির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ বহু অভিযোগ উঠেছে।

প্রথম অভিযোগ স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে মো. মাইন উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে বর্তমান দেখানো হলেও কর্তৃপক্ষ কখনও এমন কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়নি।

জানা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন কাগজপত্রে মো. মাইন উদ্দিনকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানে এ পদে কোনো ব্যক্তিই নেই। বরং সাত মাস আগে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন দাগনভূঞা কামাল আতাতুর্ক হাইস্কুলের সাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আবদুর রহিম।

অভিযোগ নম্বর দুই, স্কুলটির সহকারী শিক্ষক পদে যারা দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন, এখন তাদের বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে চলেছে। এ কর্মকাণ্ড শুরু হয় ২০২২ সালের আগস্ট মাসে, যখন এমপিওভূক্তির তালিকায় নাম আসে অরফ্যান্স সেন্টার স্কুলের।

তিন নম্বর অভিযোগটি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। জানা গেছে, ভুয়া নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা অন্তত ৪০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন।

অভিযোগগুলো এসেছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম, কথিত যুবলীগ নেতা ও বাংলাদেশ অরফ্যান্স সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক মো. সোহেল হারুনসহ দাগনভূঞার প্রভাবশালী একটি মহলের বিরুদ্ধে।

সরেজমিনে গিয়ে ‘তিন শিক্ষককে’ পাঠদান করতে দেখা গেছে। তারা আদৌ এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কোনো শিক্ষক কিনা জানা যায়নি। তাদের মধ্যে একজনের নাম অর্জুন চন্দ্র, গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায়। সেখানেও একটি স্কুলের চাকরি করেন তিনি। অরফ্যান্স সেন্টার স্কুলে তার পাঠদানের ব্যাপারে জানতে চাইলে অর্জুন বলেন, ‘সোমবার (৩০ জানুয়ারি) আগের প্রতিষ্ঠানকে না করে দিয়েছি। ’ অথচ অরফ্যান্সে তার নিয়োগ দেখানো হয়েছে আরও বহু বছর আগে।

প্রধান শিক্ষক পদে যাকে বর্তমান হিসেবে দেখানো হচ্ছে সেই মাইন উদ্দিনকে নিয়োগ ছাড়াই তথ্য জালিয়াতি করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এ স্কুলে। অভিযোগটি করেছেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ রব। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক নিয়োগের কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। স্কুলে কি হচ্ছে, কারা এসে পাঠদান করছে তা কিছুই জানি না। সেজন্য আমি কোনো কাগজে স্বাক্ষর করছি না।

তিনি আরও বলেন, আমি যখন অসুস্থ ছিলাম তখন কমিটির অন্যরা আগের প্রধান শিক্ষক আবদুর রহিমকে বাদ দিয়ে আবদুস সাত্তারকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেয়। এরপর তারা নতুন করে মাইন উদ্দিন নামের একজনকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যুক্ত করে। অথচ, এসব আমি কিছুই জানি না। আমাকে না জানিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে তারা মাইন উদ্দিনকে নিয়োগ দিতে চাইছে।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই স্কুলটির পাঠদানে যুক্ত কয়েকজন শিক্ষকের ভাষ্য, অবৈধ নিয়োগকে বৈধ করতে শিক্ষকদের হাজিরা খাতা, রেজুলেশন বই পুড়ে ফেলেছে ওই প্রভাবশালী মহল। শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হচ্ছে মাইন উদ্দিনকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রচার করতে। কথা না শুনলে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তাই চাকরি না থাকলেও কোনো শিক্ষক এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজী হচ্ছেন না।

বয়োবৃদ্ধ রহিম উল্লাহ অরফ্যান্স সেন্টার স্কুলের দপ্তরী। গত ৭ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কথাপ্রসঙ্গে রহিম জানান,  স্কুলে আগে যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তিনি এখন আর আসেন না। গত ৪-৫ মাস ধরে নতুন প্রধান শিক্ষককে (মাইন উদ্দিন) দেখছেন তিনি।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদে পুরনোদের বাদ দেওয়া ও নতুন শিক্ষকদের পুরনো হিসেবে দেখাতে নেপথ্যে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আজিজুল হকের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, গত মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড থেকে নির্দেশনা পেয়ে স্কুলটি পরিদর্শনে যান আজিজুল হকসহ তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। সেদিন স্থানীয় সাংবাদিকরা খবর পেয়ে স্কুলে যান। এবং তাদের পরিদর্শনের কারণ জানতে চান। এতে খেপে যান আজিজুল। সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন।

যদিও পরে পরিদর্শনের কারণ স্কুলের কাগজপত্র যাচাই করা বলে তিনি জানান। এ সময় স্কুলের দুর্নীতির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রসঙ্গে তুলে ধরেন উপস্থিত সাংবাদিকরা। আজিজুল কোনো কথা না বলে স্কুল থেকে বেরিয়ে চলে যান।

এসব ঘটনার বিষয়ে বাংলানিউজ যায় অরফ্যান্স সেন্টার স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাইন উদ্দিনের কাছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। একাধিক বার তাকে অভিযোগগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও তিনি কোনো কথা না বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তার নিয়োগ কীভাবে হয়েছে, কারা তার ইন্টারভিউ নিয়েছেন, বেতন-ভাতা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি স্কুলের পেছনে আবাদি জমির ওপর দিয়ে পালিয়ে যান।

জানা গেছে, মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অরফ্যান্স সেন্টার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসেছেন মাইন উদ্দিন। তার নিয়োগও বৈধ নয়। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে ঘুষ দিয়ে তিনি নিজ কার্য হাসিল করছেন। স্কুলের একটি ব্যাংক হিসাব খুলতেও তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে সই করেছেন। কিন্তু ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ রব তাতে সই করেননি।

একটি সূত্র দাবি করে, মাইন উদ্দিন বছরখানেক আগে দুধমুখা উচ্চ বিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে চাকরি করতেন।

আরও একটি সূত্র মারফত জানা গেছে, স্কুলটিতে শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করা হয়। তাদের ‘ক্ষতি হবে’ হুমকি দিয়ে পদত্যাগ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পদত্যাগ না করে স্কুলে চাকরি করতে হলে দিতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। অন্যথায় পদত্যাগই একমাত্র উপায়। নজরুল ইসলাম ও সোহেল হারুনের বিরুদ্ধেই অভিযোগগুলো উঠছে বার বার।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, জানিনা আমার ভাগ্যে কি আছে। যারা শিক্ষকদের তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন তাদের কাগজপত্রে আমার নাম নেই। মনে হয় আমাকে বাদ দিয়ে তাদের পছন্দের শিক্ষক নিচ্ছেন। আমার আত্মীয়ের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। তা নাহলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। আমার সাধ্য নেই তাদের দাবি মেটানোর।

দাতব্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অরফ্যান্স সেন্টার হাসান গণিপুরে এ প্রতিষ্ঠানটির ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করে। অরফ্যান্স সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মোহাম্মদ নূর। হাসান গণিপুর গ্রামের স্কুলে অনিয়ম প্রসঙ্গে বাংলানিউজ জানতে চায় তার কাছে। নূর বলেন, স্কুলের দীর্ঘদিনের শিক্ষকদের উপস্থিতির হাজিরা খাতা ও রেজুলেশন বই গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। ওই মহলের পছন্দের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য নতুন রেজুলেশন ও হাজিরা খাতা তৈরি করা হয়েছে। এসব অনিয়ম রুখতে আমেরিকা থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আমি অভিযোগ দিয়েছি।

বিষয়টি নিয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফী উল্লাহের সঙ্গে কথা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, গত সপ্তাহে স্কুলের বিভিন্ন অভিযোগের অনুলিপি হাতে পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু অরফ্যান্স সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নূরের অভিযোগ পত্র নাকি তিনি পাননি। এমনটি দাবি করে সরকারি এ কর্মকর্তা বলেন, তার কোনো অভিযোগ পাইনি। শিক্ষকদের কাগজপত্রে কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি সরাসরি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তবে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারেও তার উত্তর পরিষ্কার নয়। তিনি বলেন, আমার সন্তান স্কুলটির শিক্ষার্থী। সে সূত্রে বছরখানেক আগে আমি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হই। মাইন উদ্দিন কখন প্রধান শিক্ষক হয়েছেন আমি জানি না। আর কাদের বের করে দেওয়া হচ্ছে সে তথ্যও আমার কাছে নেই।

একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অরফ্যান্স সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হারুন বলেন, সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা। এ ছাড়া আর কোনো কথা বলতে চাননি তিনি।

বাংলাদেশ অরফ্যান্স সেন্টার স্কুলের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনেছেন ফেনী জেলার প্রশাসক (ডিসি) আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, স্কুলটির শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জেনেছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই কমিটি ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে তাদের আমাদের কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩
এসএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।