ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

২ বছর ধরে সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ, এমপি-সাবেক চেয়ারম্যানকে দুষছেন এলাকাবাসী

সুমন কুমার রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩
২ বছর ধরে সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ, এমপি-সাবেক চেয়ারম্যানকে দুষছেন এলাকাবাসী

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের বেগুনটাল গ্রামের খালের উপর সেতু নির্মাণের সময় শেষ হয়েছে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল। এর মধ্যে পার হয়ে গেছে আরও এক বছর ৯ মাস।

তবুও সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করা যায়নি।  

এজন্য স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান ও তার লোকজনদের দুষছেন এলাকাবাসী। যদিও এসব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহসও পাচ্ছেন না তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেগুনটাল বাজারের খালের উপর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ খানের নামে তিন কোটি ৯৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৭৫ টাকা ব্যায়ে ৫০ মিটার গার্ডার সেতুটি নির্মাণ কাজের টেন্ডার দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) টাঙ্গাইল।  

২০২০ সালে টেন্ডারে অংশ নিয়ে সেতুটি নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পায় ঢাকার মেসার্স কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জয়েন্ট ভ্যানচারে (জেভি) কাজ পান বিএনপি নেতা হুগড়া গ্রামের মো. আজগর আলী। এ কারণে আজগর আলী শাহজালাল ব্যাংক টাঙ্গাইল শাখায় একটি হিসাবও খোলেন। কিন্তু কাজ শুরুর আগেই আজগর আলী থেকে টেন্ডারটি নিয়ে নেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন, তৎকালীন চেয়ারম্যান বর্তমান সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন তোফা। এরপর এমপি ছানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তোফাজ্জল হোসেন তোফা, টাঙ্গাইল শহরের বাপ্পি ও মাহাবুব হোসেনসহ কয়েকজন মিলে কাজটি শুরু করেন। কিন্তু সেতুর পিলার, পাইল ও একটি স্লাবের কাজ শেষ করেই কাজ বন্ধ করে দেন তারা।  দীর্ঘ তিন বছরে সেতুটির মূল কাজের মধ্যে দুটি স্ল্যাব বাদ রয়েছে।  

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেতুটি নির্মাণ না হওয়ায় বন্ধ রয়েছে ট্রাক, বাসসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন পারাপার। সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য সেতুটির নিচে বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ওই রাস্তা দিয়ে সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল চলাচল করছে। হেঁটেও যাচ্ছেন মানুষ। তবে বিকল্প রাস্তাটি মূল সড়ক থেকে অনেকটা নিচু হওয়ায় বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যাওয়াসহ শুষ্ক মৌসুমে পারাপারে চরম সমস্যা পোহাতে হচ্ছে চলাচলকারীদের।  

ওই রাস্তা দিয়ে পারাপারে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন নারী, শিশু, বৃদ্ধ পথচারীসহ পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা।  

নির্মানধীন এই সেতুর নিচ দিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর, টাঙ্গাইলের কাকুয়া ও কাতুলী ইউনিয়নের তোরাবগঞ্জসহ এ ইউনিয়নের পূর্ব হুগড়া, চক গোপাল, সাতানি হুগড়া, ধুলবাড়ী, কচুয়া, বারবয়লা, মহেশপুর, গইরাগাছা, মালতিপাড়া, আনাহলা, চিনাখালী, গন্ধবপুর, বইরাপাড়া, ভাঙ্গাবাড়ী, নরসিংহপুর, গোপাল কেউটিসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন।  

সেতুটি নির্মাণ না হওয়ায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে যাতায়াত করতে হচ্ছে তাদের।

মোবারক মিয়া নামের স্থানীয় বাসিন্দা জানান, এই ইউনিয়নের পশ্চিম অংশের যমুনা নদীর তীরবর্তী গ্রাম, কাকুয়া ও কাতুলীর তোরাবগঞ্জসহ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম এই নির্মাণাধীন সেতুর বিকল্প রাস্তা। ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি এখনও।
 
বেগুনটাল গ্রামের মিহীর উদ্দিন জানান, শুনেছি এই সেতুটির কাজ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতা আজগর আলী। পরবর্তীতে তার কাছ থেকে এমপি ও তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজটি নিয়ে নেন। কয়েক মাস কাজ করার পর হঠাৎ করেই কাজ বন্ধ রাখা হয়। এতে করে চরম দুর্ভোগে পরেছি আমরা।

অটোরিকশাচালক জমসের মিয়া জানান, অনেক কষ্ট করে বিকল্প রাস্তা দিয়ে অটোরিকশা নিয়ে যেতে হয়। তারপরও প্রতিবাদ করি না। কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব? সেতুটির ঠিকাদার সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা তোফাজ্জল হোসেন খান তোফা।
 
সংশ্লিষ্ট কাজের রড মিস্ত্রির সহযোগী হৃদয় সরকার বলেন, সেন্টারিংয়ের কাঠ আর রড না থাকায় সেতুটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। ঠিকাদার রড পাঠালে আবার পুনরায় কাজ শুরু করা হবে।

হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নূরে আলম তুহিন বলেন, সেতুটির কাজ শেষ না করায় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে দফায় কাঠের সেতু নির্মাণ করেছিলাম। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে সেতুর নিচ দিয়ে মাটি ফেলে বিকল্প ডাইবেশনটিও করেছি আমি। জনগণের ভোগান্তির বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্যকে জানানো হয়েছে। তিনি আগামী বর্ষার আগেই সেতুটি নির্মাণের কাজ শেষ করার জন্য এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দেবেন বলে জানিয়েছেন।

সেতুটি নির্মানের মূল সাব ঠিকাদার বিএনপি নেতা মো. আজগর আলী বাংলানিউজকে জানান, কাজটি আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু সংসদ সদস্য ও সাবেক চেয়ারম্যান এবং তাদের লোকজন কাজটি করবেন বলে আমাকে জানায়। আমি কাজটি তাদেরকেই দিয়ে দিই। এ কারণে সংসদ সদস্যের কাছে আমি শাহজালাল ব্যাংক টাঙ্গাইল শাখার একটি চেক বইও দিয়েছি।  

তিনি আরও বলেন, এ কাজ বাবদ এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই কোটি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন তারা। গত এক মাস আগেও ৬৯ লাখ টাকা বিল প্রদান করা হয়েছে তাদের।  

কাজটি বন্ধের বিষয়ে আজগর আলী বলেন, আমি কাজটি করলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্মাণ কাজ শেষ করে ফেলতাম।
 
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, এই প্রজেক্টের ফান্ড সংকট থাকায় সেতু নির্মাণের কাজ সময় মতো শেষ করা যায়নি। এরপরও ঠিকাদারকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। দ্রুতই সেতুটির কাজ আবার শুরু হবে।

টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মো. ছানোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, রড, সিমেন্টসহ কাজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিসহ প্রজেক্টে ফান্ড থাকার অজুহাত দেখাচ্ছেন ঠিকাদাররা। তারপরও ঠিকাদারকে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। আর সময় মতো কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।  

তবে তিনি নিজে কাজটি করছেন না বলে জানালেও তার লোকজনই কাজ করছেন বলে স্বীকার করেন এ সংসদ সদস্য।  

চেকের বিষয়ে তিনি বলেন, চেকের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে মূল ঠিকাদারের কাছে আমার লোকজন অনেক আগে থেকেই টাকা পাবেন।  

বাংলাদেশ সময়: ০১১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।